✍️রচনাধর্মী প্রশ্নগুলির উত্তর দাও(প্রশ্নের মান-৮):
১.ফরাসি বিপ্লবের ক্ষেত্রে দার্শনিকদের ভূমিকা ব্যাখ্যা কর।
উত্তর: ফরাসি বিপ্লবের (১৭৮৯) পেছনে দার্শনিকদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল। তারা তাদের চিন্তা ও লেখনীর মাধ্যমে জনগণকে রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করেন এবং স্বাধীনতা ও সাম্যের ধারণা প্রতিষ্ঠিত করেন।
জন লকের মতবাদ: তিনি মানুষের স্বাভাবিক অধিকার (জীবন, স্বাধীনতা, সম্পত্তি) সম্পর্কে কথা বলেন, যা জনগণের মধ্যে স্বাধীনতার চেতনা সৃষ্টি করে।
রুশোর সামাজিক চুক্তি তত্ত্ব: তার The Social Contract গ্রন্থে জনগণের সার্বভৌমত্বের ধারণা তুলে ধরা হয়, যা গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার ভিত্তি গড়ে তোলে।
ভলতেয়ারের স্বাধীনতা ভাবনা: তিনি বাকস্বাধীনতা, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং রাজতন্ত্রের সমালোচনা করেন, যা ফরাসি সমাজে নতুন চিন্তার জোয়ার আনে।
মন্টেস্কুর ক্ষমতার বিভাজন তত্ত্ব: তার লেখা The Spirit of the Laws গ্রন্থে বিচার, আইন ও নির্বাহী বিভাগের পৃথকীকরণের কথা বলা হয়, যা পরবর্তী শাসনব্যবস্থাকে প্রভাবিত করে।
দিদরোর জ্ঞানের প্রচার: তিনি Encyclopedia প্রকাশ করেন, যেখানে যুক্তি, বিজ্ঞান ও মানবাধিকারের গুরুত্ব তুলে ধরা হয়।
রাজতন্ত্রের সমালোচনা: দার্শনিকরা ফ্রান্সের অত্যাচারী শাসন ও সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করেন, যা বিপ্লবীদের উজ্জীবিত করে।
সামন্ততন্ত্রের বিরুদ্ধে অবস্থান: Enlightenment দার্শনিকরা সামন্তপ্রথার সমালোচনা করেন, যা কৃষক ও সাধারণ জনগণের মধ্যে বিদ্রোহী মনোভাব তৈরি করে।
নতুন সমাজব্যবস্থার ধারণা: দার্শনিকদের চিন্তার ফলে ফ্রান্সে সাম্য, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রভিত্তিক একটি নতুন সমাজ গঠনের দাবি ওঠে।
ফরাসি বিপ্লব দার্শনিকদের আদর্শ দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়। তাদের মতবাদ রাজতন্ত্রের পতন ঘটিয়ে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার পথ সুগম করে এবং পরবর্তী কালে বিশ্বব্যাপী স্বাধীনতা আন্দোলনকে অনুপ্রাণিত করে।
২.বাস্তিল দুর্গের পতনের কারণ এবং এর গুরুত্ব বিশ্লেষণ কর।
উত্তর: বাস্তিল দুর্গের পতন ফরাসি বিপ্লবের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, যা ১৭৮৯ সালের ১৪ জুলাই সংঘটিত হয়। এটি ফ্রান্সে রাজতন্ত্রের অবসান ও গণতন্ত্রের পথপ্রসস্ত করে। বাস্তিল দুর্গের পতনের প্রধান কারণ ও গুরুত্ব নিচে ব্যাখ্যা করা হলো—
বাস্তিল দুর্গের পতনের কারণ:
রাজতন্ত্রের অত্যাচার: ফ্রান্সের জনগণ দীর্ঘদিন ধরে রাজা ষোড়শ লুই ও সামন্তপ্রভুদের অত্যাচার ও দমননীতির শিকার ছিল। বাস্তিল দুর্গ রাজতন্ত্রের দমননীতির প্রতীক হওয়ায় জনগণ এটিকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল।
অর্থনৈতিক সংকট: ফ্রান্সের অর্থনীতি দুর্বল হয়ে পড়েছিল এবং সাধারণ মানুষ খাদ্যসংকট ও উচ্চ করের চাপে পিষ্ট হচ্ছিল। এই সংকট জনগণের মধ্যে চরম অসন্তোষের সৃষ্টি করেছিল।
সামাজিক বৈষম্য: ফ্রান্সের সমাজ তিনটি স্তরে বিভক্ত ছিল—রাজপরিবার ও অভিজাত শ্রেণি বিলাসী জীবনযাপন করলেও কৃষক ও মধ্যবিত্তরা চরম দারিদ্র্যে দিন কাটাত। ফলে তারা বিদ্রোহে সামিল হয়।
বিদ্রোহীদের অস্ত্রের প্রয়োজন: বিপ্লবীরা রাজপ্রাসাদ দখলের পরিকল্পনা করছিল, যার জন্য তাদের অস্ত্র দরকার ছিল। বাস্তিল দুর্গে প্রচুর বন্দুক ও কামান মজুত থাকায় তারা এটি দখল করতে চেয়েছিল।
বাস্তিল দুর্গ পতনের গুরুত্ব:
ফরাসি বিপ্লবের সূচনা: বাস্তিল দুর্গের পতনের মাধ্যমে ফরাসি বিপ্লব আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় এবং রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে গণবিপ্লবের সূচনা ঘটে।
রাজশক্তির দুর্বলতা প্রকাশ: দুর্গটি রাজা ও সরকারের শক্তির প্রতীক ছিল। এটি পতনের মাধ্যমে জনগণ বুঝতে পারে যে, রাজা আর অপ্রতিরোধ্য নন।
সাম্য, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের ধারণার বিস্তার: এই ঘটনার ফলে ফ্রান্সসহ পুরো ইউরোপে জনগণের মধ্যে স্বাধীনতা, সাম্য ও ভ্রাতৃত্ববোধের ধারণা ছড়িয়ে পড়ে।
ফ্রান্সের জাতীয় দিবস: ১৪ জুলাই দিনটি এখন ফ্রান্সের জাতীয় দিবস হিসেবে পালিত হয়, যা জনগণের শক্তি ও গণতন্ত্রের বিজয়কে স্মরণ করায়।
বাস্তিল দুর্গের পতন শুধু একটি দুর্গ দখলের ঘটনা নয়, এটি ফ্রান্সের রাজতন্ত্রের অবসানের সূচনা করে এবং আধুনিক গণতন্ত্রের ভিত্তি স্থাপন করে।
৩.নেপোলিয়নের বিভিন্ন ধরনের সংস্কার সম্পর্কে আলোচনা করো।
উত্তর: নেপোলিয়ন শুধুমাত্র এক মহাশক্তিশালী সম্রাট ছিলেন না, বরং তিনি একজন দক্ষ প্রশাসক ও সংস্কারকও ছিলেন। তার বিভিন্ন সংস্কার ফ্রান্সের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কাঠামোকে নতুনভাবে গড়ে তুলতে সাহায্য করে এবং পরবর্তীকালে ইউরোপের অন্যান্য দেশেও প্রভাব ফেলে।
প্রশাসনিক সংস্কার – ফ্রান্সকে সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালনা করতে তিনি দেশটিকে ৮৩টি প্রশাসনিক বিভাগে ভাগ করেন এবং প্রতিটি বিভাগে ‘প্রিফেক্ট’ ও ‘সাব-প্রিফেক্ট’ নিয়োগ করেন। এর ফলে কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা আরও শক্তিশালী হয়।
আইন সংস্কার – ১৮০৪ সালে নেপোলিয়ন ‘কোড নেপোলিয়ন’ প্রবর্তন করেন, যা ব্যক্তি স্বাধীনতা, সম্পত্তির অধিকার এবং আইনের দৃষ্টিতে সকলের সমতার নীতি প্রচলন করে। এই আইন ইউরোপের বহু দেশে আইন ব্যবস্থার ভিত্তি হয়ে ওঠে।
শিক্ষা সংস্কার – আধুনিক শিক্ষার প্রসারে তিনি ‘ইউনিভার্সিটি অফ ফ্রান্স’ প্রতিষ্ঠা করেন এবং কারিগরি, বিজ্ঞান ও উচ্চশিক্ষার উন্নতির জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। এর ফলে যোগ্য ও দক্ষ প্রশাসক ও পেশাজীবী তৈরি হয়।
অর্থনৈতিক সংস্কার – ফ্রান্সের অর্থনীতিকে সুসংহত করতে তিনি ‘ব্যাংক অফ ফ্রান্স’ স্থাপন করেন, সরকারি ব্যয় কমিয়ে আনার ব্যবস্থা নেন এবং কর ব্যবস্থায় পরিবর্তন এনে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখেন।
ধর্মীয় সংস্কার – পোপের সঙ্গে ‘কনকর্ডাট’ চুক্তি করে তিনি ক্যাথলিক ধর্মকে স্বীকৃতি দেন এবং গির্জার সম্পত্তি রক্ষা করেন। পাশাপাশি তিনি ধর্মীয় স্বাধীনতাও নিশ্চিত করেন, যাতে জনগণের মধ্যে ধর্মীয় বিভেদ কমে।
যোগাযোগ ও অবকাঠামো উন্নয়ন – তিনি সড়ক, সেতু এবং খাল নির্মাণের মাধ্যমে ফ্রান্সের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ঘটান, যা বাণিজ্য ও শিল্পের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
কৃষি ও ভূমি সংস্কার – কৃষকদের ভূমির মালিকানা নিশ্চিত করেন, যার ফলে তারা নিজেদের জমিতে স্বাধীনভাবে চাষ করতে পারে। এটি সামন্ততন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে কৃষিক্ষেত্রে বিপুল উন্নতি সাধন করে।
সামরিক সংস্কার – সেনাবাহিনীকে আধুনিক ও দক্ষ করতে তিনি নতুন যুদ্ধ কৌশল প্রবর্তন করেন এবং যোগ্যতার ভিত্তিতে সেনা কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দেন। এর ফলে ফরাসি বাহিনী ইউরোপের অন্যতম শক্তিশালী বাহিনীতে পরিণত হয়।
নেপোলিয়নের এই সংস্কারসমূহ ফ্রান্সের রাজনীতি, প্রশাসন, অর্থনীতি এবং সমাজব্যবস্থাকে নতুন রূপ দেয়। তার শাসনব্যবস্থা ইউরোপের আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার ভিত্তি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
৪.নেপোলিয়ন কেন রাশিয়া আক্রমণ করেছিলেন? তার মূল কারণগুলি ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: নেপোলিয়নের রাশিয়া আক্রমণের পেছনে বিভিন্ন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও কৌশলগত কারণ কাজ করেছিল। নিচে প্রধান কারণগুলো আলোচনা করা হলো—
টিলসিট চুক্তি লঙ্ঘন – ১৮০৭ সালে ফ্রান্স ও রাশিয়ার মধ্যে টিলসিট চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যেখানে রাশিয়া নেপোলিয়নের মহাদেশীয় অবরোধ নীতিতে যোগ দিতে সম্মত হয়। কিন্তু পরবর্তীতে রাশিয়া এই চুক্তি ভঙ্গ করে, যা দুই দেশের সম্পর্কে ফাটল সৃষ্টি করে
ব্রিটেনের বিরুদ্ধে মহাদেশীয় অবরোধ নীতি – নেপোলিয়ন ইউরোপজুড়ে ব্রিটিশ পণ্যের প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছিলেন, যাতে ব্রিটেনের অর্থনীতি দুর্বল হয়ে পড়ে। কিন্তু রাশিয়া এই অবরোধ মানতে রাজি হয়নি এবং ব্রিটেনের সঙ্গে বাণিজ্য চালিয়ে যেতে থাকে। ফলে নেপোলিয়ন রাশিয়াকে শাস্তি দিতে চান।
গ্র্যান্ড ডাচি অব ওয়ারস সংকট – নেপোলিয়ন পোল্যান্ডের কিছু অংশ নিয়ে ‘গ্র্যান্ড ডাচি অব ওয়ারস’ গঠন করেন, যা রাশিয়ার সীমান্তের কাছে ছিল। রাশিয়া এটিকে তাদের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে এবং এই অঞ্চল নিয়ে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা বাড়তে থাকে।
ফ্রান্স-অস্ট্রিয়া সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা – নেপোলিয়ন যখন অস্ট্রিয়ার রাজকন্যা মেরি লুইসাকে বিয়ে করেন, তখন রাশিয়ার জার মনে করেন, এটি ফ্রান্স ও অস্ট্রিয়ার মধ্যে একটি কৌশলগত জোট, যা রাশিয়ার জন্য বিপজ্জনক হতে পারে।অর্থনৈতিক স্বার্থ – ব্রিটেনের সঙ্গে বাণিজ্য বন্ধ করে রাশিয়া অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে। তাই তারা মহাদেশীয় অবরোধ থেকে সরে আসে এবং ব্রিটেনের সঙ্গে পুনরায় ব্যবসা শুরু করে। এতে নেপোলিয়ন ক্ষুব্ধ হন এবং সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন।
সাম্রাজ্য বিস্তারের আকাঙ্ক্ষা – নেপোলিয়ন চেয়েছিলেন ইউরোপজুড়ে তার আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে এবং রাশিয়াকে বশে আনতে পারলে তার সাম্রাজ্য আরও শক্তিশালী হবে বলে মনে করতেন।রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব – নেপোলিয়ন ও রাশিয়ার জার আলেকজান্ডারের মধ্যে রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে, যা যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয়।
শক্তি প্রদর্শনের বাসনা – নেপোলিয়ন বিশ্বাস করতেন, রাশিয়াকে পরাজিত করতে পারলে ইউরোপের অন্যান্য দেশও তার ক্ষমতাকে ভয় পাবে এবং তার শাসন আরও সুসংহত হবে।
এই কারণগুলোর সমষ্টিতেই ১৮১২ সালে নেপোলিয়ন বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে রাশিয়া আক্রমণ করেন, যা পরবর্তীতে তার সাম্রাজ্যের পতনের অন্যতম কারণ হয়ে ওঠে।
<<<<<<<<<<<<<<🌹 সমাপ্ত 🌹>>>>>>>>>>>>