✍️রচনাধর্মী প্রশ্নগুলির উত্তর দাও(প্রশ্নের মান-৫):
১. ইজারাদারি ব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করো।
উত্তর:
সূচনা: ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে ওয়ারেন হেস্টিংসের শাসনকালে ইজারাদারি ব্যবস্থা চালু করা হয়। এই ব্যবস্থার মাধ্যমে জমির কর বা রাজস্ব সংগ্রহের কাজ ইজারাদারদের হাতে ন্যস্ত করা হয়।ইজারাদারি ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য:
প্রথমত, ইজারাদাররা জমি চাষের জন্য কৃষকদের কাছ থেকে কর সংগ্রহ করত। তারা সরকারের কাছে নির্দিষ্ট পরিমাণ রাজস্ব প্রদানের দায়িত্ব নিত।
দ্বিতীয়ত, ইজারাদাররা এক বা একাধিক বছরের জন্য জমি লিজ হিসেবে গ্রহণ করত। তারা লিজের সময়কালে জমির সমস্ত আয় উপভোগের অধিকার পেত।
তৃতীয়ত, এই ব্যবস্থায় ইজারাদাররা কৃষকদের উপর চরম শোষণ করত। অধিক মুনাফা লাভের জন্য তারা কৃষকদের কাছ থেকে অতিরিক্ত কর আদায় করত।
চতুর্থত, ইজারাদারদের মাধ্যমে রাজস্ব সংগ্রহের ফলে কৃষকদের অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়ে। অনেক ক্ষেত্রেই তারা ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ত এবং জমি চাষ করার ক্ষমতা হারাত।
পঞ্চমত, ইজারাদারি ব্যবস্থার মাধ্যমে সরকার নির্দিষ্ট পরিমাণ রাজস্ব সংগ্রহের নিশ্চয়তা পেত। তবে কৃষকরা এই ব্যবস্থার কারণে মারাত্মক কষ্ট ভোগ করত।
উপসংহার:
ইজারাদারি ব্যবস্থা ব্রিটিশ শাসনের আর্থিক নীতির একটি অংশ ছিল যা কৃষকদের উপর গুরুতর শোষণের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। পরে এই ব্যবস্থা বাতিল করে আরও কার্যকর ও ন্যায়সঙ্গত পদ্ধতি চালু করার চেষ্টা করা হয়।
২. ব্রিটিশ কোম্পানির প্রশাসন ব্যবস্থায় আমলাতন্ত্রের ভূমিকা কী ছিল? কীভাবে আমলারা একটি সংকীর্ণ গোষ্ঠী হিসেবে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল?
উত্তর:
সূচনা: ব্রিটিশ কোম্পানির প্রশাসন ব্যবস্থায় আমলাতন্ত্র ছিল একটি শক্তিশালী ও সুসংগঠিত কাঠামো, যা ভারতের শাসন ও প্রশাসনে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার মূল উপায় হয়ে ওঠে।
আমলাতন্ত্রের ভূমিকা: প্রথমত, ব্রিটিশ আমলাতন্ত্রের মাধ্যমে শাসনকাজ পরিচালনা ও আইন প্রয়োগ করা হতো। প্রশাসনিক আদেশ কার্যকর করা এবং আইনানুগ শাসন প্রতিষ্ঠা ছিল তাদের প্রধান দায়িত্ব।
দ্বিতীয়ত, আমলাতন্ত্র ছিল একটি কেন্দ্রীভূত প্রশাসনিক কাঠামো। সরকারের বিভিন্ন স্তরে নিয়োগকৃত কর্মচারীরা ব্রিটিশ সরকারের নির্দেশ পালন করত।
তৃতীয়ত, আমলারা কর আদায়ের কাজ পরিচালনা করত। এই ব্যবস্থার মাধ্যমে রাজস্ব সংগ্রহের পাশাপাশি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বও পালন করা হতো।
চতুর্থত, আমলাতন্ত্রের সদস্যরা বিশেষ সুযোগ-সুবিধা ও ক্ষমতার অধিকারী ছিল। তারা নিজেদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখে একটি সংকীর্ণ গোষ্ঠী হিসেবে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল।
উপসংহার: ব্রিটিশ আমলাতন্ত্র ভারতীয় সমাজের উপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে এবং নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছিল।
৩. পলাশির যুদ্ধ অপেক্ষা বক্সারের যুদ্ধ গুরুত্বপূর্ণ কেন আলোচনা করো।
অথবা, বক্সারের যুদ্ধের গুরুত্ব আলোচনা করো।
উত্তর:
সূচনা: পলাশির যুদ্ধ ও বক্সারের যুদ্ধ উভয়ই ভারতের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলেও বক্সারের যুদ্ধ অধিক গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কারণ এটি ব্রিটিশদের ক্ষমতার বিস্তারের ভিত্তি স্থাপন করে।
বক্সারের যুদ্ধের গুরুত্ব:
প্রথমত, পলাশির যুদ্ধ ছিল মূলত স্থানীয় শক্তির বিরুদ্ধে ব্রিটিশদের বিজয়। তবে বক্সারের যুদ্ধে ব্রিটিশরা বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার যৌথ শক্তিকে পরাস্ত করেছিল।
দ্বিতীয়ত, বক্সারের যুদ্ধের পর ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মুঘল সম্রাট শাহ আলম থেকে দেওয়ানি লাভ করে। এই দেওয়ানি লাভের ফলে কোম্পানি বাংলার রাজস্ব আদায়ের নিয়ন্ত্রণ অর্জন করে।
তৃতীয়ত, বক্সারের যুদ্ধ ব্রিটিশদের সামরিক ও প্রশাসনিক শক্তি বৃদ্ধির কারণ হয়। এই যুদ্ধে জয়ের মাধ্যমে কোম্পানি ভারতের বৃহৎ অঞ্চলে তাদের শাসন প্রতিষ্ঠা করে।
চতুর্থত, পলাশির যুদ্ধ ছিল মূলত বিশ্বাসঘাতকতার মাধ্যমে অর্জিত, কিন্তু বক্সারের যুদ্ধ ছিল সামরিক দক্ষতার মাধ্যমে অর্জিত। ফলে এটি ব্রিটিশদের শাসনকে আরও বৈধতা প্রদান করে।
উপসংহার: বক্সারের যুদ্ধের ফলাফল ব্রিটিশদের ভারতের শাসনে স্থায়ী ভিত্তি স্থাপন করতে সহায়ক হয়, যা পলাশির যুদ্ধের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
৪. নবাব সিরাজউদ্দৌলার সঙ্গে ইংরেজদের বিরোধের কারণগুলি উল্লেখ করো।
উত্তর: নবাব সিরাজউদ্দৌলার সঙ্গে ইংরেজদের বিরোধের পাঁচটি কারণ হল:
দুর্গ নির্মাণের সমস্যা: ইংরেজরা নবাবের অনুমতি ছাড়াই কলকাতায় দুর্গ নির্মাণ করে ও সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করেছিল। এটি নবাবের শাসন ক্ষমতার প্রতি হুমকি সৃষ্টি করেছিল।
বাণিজ্যিক সুবিধা নিয়ে বিরোধ: ইংরেজরা বিনা শুল্কে বাণিজ্য করার অধিকার দাবি করত। এছাড়াও, বিভিন্ন স্থানে নতুন কুঠি নির্মাণ করাও বিরোধের কারণ ছিল।
রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র: ইংরেজরা নবাবের বিরোধীদের সমর্থন করত এবং অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করত। এই ষড়যন্ত্রগুলি নবাবের শাসনকে অস্থিতিশীল করে তুলেছিল।
রাজস্ব না দেওয়া: ইংরেজরা তাদের বাণিজ্যিক কার্যক্রম থেকে নবাবের রাজস্ব আদায়ের অধিকারকে উপেক্ষা করত। এতে নবাবের অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়।
ফরমানের অপব্যবহার: ১৭১৭ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট ফাররুখশিয়র ইংরেজদের বাণিজ্য করার সুবিধার জন্য যে ফরমান দিয়েছিলেন, ইংরেজরা তার অপব্যবহার করত। তারা বিনা শুল্কে ব্যাপক পরিমাণে বাণিজ্য চালিয়ে যেত।
৫.ওয়ারেন হেস্টিংস ও লর্ড কর্নওয়ালিসের বিচারব্যবস্থার সংস্কারের তুলনামূলক বিশ্লেষণ করো এবং এর প্রভাব ভারতীয়দের উপর কীভাবে পড়েছিল তা ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: ওয়ারেন হেস্টিংস ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে নতুন বিচারব্যবস্থা চালু করে দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালত পৃথক করেন। তিনি হিন্দু ও মুসলিম আইন ইংরেজিতে অনুবাদ করিয়ে ইউরোপীয় বিচারকদের ভারতীয় সহকারীদের উপর নির্ভরশীলতা কমানোর ব্যবস্থা করেন। হেস্টিংস সুপ্রিম কোর্ট প্রতিষ্ঠা করেন, যা শুধু ব্রিটিশ নাগরিকদের বিচার করত। তাঁর বিচারব্যবস্থা ভারতীয়দের ন্যায়বিচারের সুযোগ বাড়ালেও ইউরোপীয়দের আধিপত্য বৃদ্ধি পায়।
লর্ড কর্নওয়ালিস ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে বিদ্যমান আইনগুলোকে কোড আকারে সাজিয়ে সুসংহত করেন। তিনি দেওয়ানি বিচার ও রাজস্ব ব্যবস্থাকে পৃথক করার মাধ্যমে দুর্নীতি কমানোর উদ্যোগ নেন। কর্নওয়ালিস নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চতর আদালতে আপিলের সুযোগ দেন। তাঁর আইনি সংস্কার ভারতীয়দের উচ্চপদে নিয়োগের সুযোগকে সীমিত করে।
এই দুই শাসকের বিচারব্যবস্থা ভারতীয় সমাজে গভীর প্রভাব ফেলে। ইউরোপীয় বিচারকদের আধিপত্য বৃদ্ধির ফলে ভারতীয়দের বিচারিক ক্ষমতা কমে যায়। আদালতের জটিল প্রক্রিয়া সাধারণ মানুষের ন্যায়বিচারের পথে বাধা সৃষ্টি করে। ঔপনিবেশিক শাসনকে শক্তিশালী করার জন্য এই বিচারব্যবস্থা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
<<<<<<<<<<<<<<🌹 সমাপ্ত 🌹>>>>>>>>>>>>