🌹 একাদশ শ্রেণির বাংলা ফাইনাল সাজেশন-২০২৫:: সেমিস্টার-২::১০০% কমন আসবেই।🌹

 

 

 

✍️প্রশ্নের মান-৫:

                 ছোটোগল্প:

১. “ছুটি” গল্পে মামার বাড়িতে গিয়ে ফটিকের যে দুরবস্থা হয়েছিল তা নিজের ভাষায় লেখ।

উত্তর: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ছুটি’ গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র ফটিক, যে গ্রামে প্রকৃতির মাঝে স্বাধীনভাবে বেড়ে ওঠা দুরন্ত কিশোর। দুষ্টুমি আর নেতৃত্বের কারণে সে সবার কাছে পরিচিত হলেও, তার মা তার উচ্ছৃঙ্খল স্বভাব নিয়ে চিন্তিত ছিলেন।

একদিন মামা বিশ্বম্ভরবাবু এসে ফটিককে কলকাতায় নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দেন। ফটিক ও তার মা রাজি হন। কিন্তু কলকাতায় গিয়ে মামীর শীতল আচরণ, শহরের যান্ত্রিক জীবন ও স্কুলের কঠোর নিয়ম তাকে বিষাদগ্রস্ত করে তোলে। সে গ্রাম, প্রকৃতি আর মায়ের স্নেহের জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে।

অপেক্ষার প্রহর শেষ হয় না। একদিন স্কুলে বই হারানোর পর অপমান সহ্য করতে না পেরে সে ঝড়-জলের রাতে বাড়ি ছাড়ে। পুলিশ তাকে উদ্ধার করে ফিরিয়ে আনে, কিন্তু সে তখন প্রবল জ্বরে আক্রান্ত। অসংলগ্নভাবে প্রলাপ বকতে থাকে— “এক বাঁও মেলে না, দো বাঁও মেলে না”।

অবশেষে, মৃত্যুশয্যায় সে মায়ের কাছে ‘ছুটি’ চায়— শহরের বন্দিদশা থেকে, জীবনের বন্ধন থেকে চিরমুক্তির ছুটি।

২.প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘তেলেনাপোতা আবিষ্কার’ গল্পকে আসলে আত্ম-আবিষ্কারের গল্প - বিষয়বস্তু নিরিখে বক্তব্যটি ব্যাখ্যা কর। 

উত্তর: প্রেমেন্দ্র মিত্রের ছোটগল্প “তেলেনাপোতা আবিষ্কার”, যা ১৯৪৬ সালে প্রকাশিত “কুড়িয়ে ছড়িয়ে” গল্পগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত, বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছোটগল্প হিসেবে বিবেচিত হয়। গল্পটি বিষয়বস্তু ও বর্ণনার অভিনবত্বে অনন্য।

গল্পের নায়ক নামহীন এবং মধ্যম পুরুষে লেখা হওয়ায় পাঠক নিজেই যেন গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র হয়ে ওঠে। গল্পের প্রতিটি পর্যায়ে নায়কের অনুভূতি, দ্বিধা, করুণা, সহমর্মিতা এবং পলায়নী মনোভাব গভীরভাবে প্রতিফলিত হয়।

তিনদিনের ছুটিতে মাছ ধরার বাসনায় শহর থেকে দূরে জনবিরল এক গ্রামে পৌঁছানোর অভিজ্ঞতা পাঠকের মনে রোমাঞ্চ জাগায়। সেখানে গিয়ে সে সাক্ষাৎ পায় এক মৃতপ্রায় বৃদ্ধা ও তার মেয়ে যামিনীর করুণ বাস্তবতার। এই পরিস্থিতি দেখে পাঠকের মনও সহানুভূতিতে ভরে ওঠে, নায়কের মতো সেও যামিনীর জন্য কিছু করতে চায়।

তবে বাস্তবতা খুব দ্রুতই তার কল্পনার মোহ ভেঙে দেয়। শহরে ফিরে এসে, অসুস্থতা কাটিয়ে ওঠার পর, সেই তেলেনাপোতার স্মৃতি তার কাছে যেন এক দূরবর্তী স্বপ্নের মতো মনে হয়। মধ্যবিত্তের দ্বিধাগ্রস্ত মানসিকতা, সংবেদনশীলতা ও বাস্তবতাবোধের সংঘাত এই গল্পের মূল ভাবনাকে স্পষ্ট করে তোলে।

এইভাবে, “তেলেনাপোতা আবিষ্কার” কেবল একটি জনপদ আবিষ্কারের গল্প নয়, এটি এক অনন্য আত্ম-আবিষ্কারের রূপক, যেখানে নায়ক তথা পাঠক নিজের ভেতরের জগতকে আবিষ্কার করে।

৩."মনে হবে তেলেনাপোতা বলে কোথাও কিছু সত্যি নেই" - এ কথা কার, কেন মনে হবে? এই মনে হওয়ার কারণ কি?

উত্তর: গল্পের নায়ক একজন শহুরে মানুষ, যার অভিজ্ঞতা ও স্মৃতি নিয়ে গল্পকার সূক্ষ্মভাবে একটি বাস্তবধর্মী চিত্র এঁকেছেন। তেলেনাপোতা থেকে ফিরে আসার পর, সে দীর্ঘদিন ম্যালেরিয়ায় ভুগেছিল। অসুস্থতার কারণে তার দেহ ও মন অবচেতনে অনেক কিছু ভুলে যেতে থাকে। সুস্থ হয়ে যখন সে প্রথমবারের মতো আলো-হাওয়ায় বের হয়, তখন তার মনে তেলেনাপোতার স্মৃতি একেবারেই ঝাপসা হয়ে যায়।

অস্তগামী তারার মতো সেই স্মৃতি যেন বিলীন হয়ে যায়। ঘুমের মধ্যে দেখা স্বপ্ন যেমন বাস্তবজীবনে ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায়, তেমনভাবেই তেলেনাপোতার ঘটনাগুলিও তার মন থেকে মুছে যেতে থাকে। একসময় সে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে, আবার সেখানে ফিরে যাবে—কিন্তু এখন তা কেবল কথার কথায় পরিণত হয়েছে। এমনকি যখন কেউ তাকে মনে করিয়ে দেয় যে, তার ছিপ সেখানে পড়ে আছে, সে তখন নিস্পৃহভাবে বলে, “থাক না। এবারে পারিনি বলে কি তেলেনাপোতার মাছ বারবার ফাঁকি দিতে পারবে?”

আসলে, এখন তার মনেই হয় না যে তেলেনাপোতা নামে সত্যিই কোনো জায়গা ছিল। বাস্তবতা ও কল্পনার সীমারেখা মিলিয়ে গেছে, তার স্মৃতিতে তেলেনাপোতা যেন একটি মুছে যাওয়া স্লেটের মতো।

                     কবিতা:

১. ভাব সম্মিলন কাকে বলে? আলোচ্য পদটিতে রাধার আনন্দের যে চিত্র ফুটে উঠেছে তা নিজের ভাষায় লেখ।

উত্তর: কৃষ্ণ মথুরায় চলে যাওয়ার পর আর বৃন্দাবনে ফিরে আসেননি। তবে বৈয়ব মহাজনরা রাধার বিরহ-কাতরতা সহ্য করতে পারেননি, তাই তাঁরা মানসিকভাবে রাধা-কৃষ্ণের মিলন কল্পনা করেন, যা ভাবসম্মিলন নামে পরিচিত। এই ভাবসম্মিলনের আনন্দই বিদ্যাপতির বিখ্যাত পদ ‘কি কহব রে সখি আনন্দ ওর’-এ প্রকাশিত হয়েছে।

এই পদে বিরহ শেষে মিলনে উল্লসিত রাধার আনন্দ-উচ্ছ্বাস স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। তিনি সখিকে বলেন, তাঁর আনন্দের কোনো সীমা নেই, কারণ এবার আর কৃষ্ণকে হারানোর ভয় নেই। কৃষ্ণ চিরদিনের জন্য তাঁর কাছে থেকে গেছেন। বিরহের যন্ত্রণা যে গভীর দুঃখ দিয়েছে, আজ মিলন সেই দুঃখকে ততটাই সুখে পরিণত করেছে। রাধা এতটাই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছেন যে কেউ যদি তাঁকে মহারত্ন দিয়েও কৃষ্ণকে দূরদেশে পাঠাতে বলেন, তবুও তিনি কখনো রাজি হবেন না।

বিদ্যাপতি রাধা-কৃষ্ণের প্রেমকে মানবিক ও বাস্তবতার সঙ্গে যুক্ত করে তুলেছেন। রাধার কাছে কৃষ্ণ শুধুমাত্র প্রেমিক নন, বরং তিনি জীবনের অপরিহার্য অংশ। রাধা কৃষ্ণকে তুলনা করেছেন শীতের উষ্ণ বস্ত্র, গ্রীষ্মের ঠান্ডা বাতাস, বর্ষার ছাতা এবং বিপদের মাঝেও রক্ষাকর্তা নৌকার সঙ্গে। এই উপমাগুলো রাধার গভীর প্রেম ও তাঁর অন্তরের নিবিড় অনুভূতি প্রকাশ করেছে।

বিদ্যাপতি যদিও বৈয়ব তত্ত্ব পুরোপুরি অনুসরণ করেননি, তবুও রাধার প্রেমজ অনুভূতিকে গভীর কাব্যিক আবহে ফুটিয়ে তুলেছেন। কৃষ্ণ-প্রেমে রাধার আত্মবিসর্জনের এই অনুভূতি ভাবসম্মিলনের পরিপূর্ণ রূপ প্রদান করেছে।

২.লালন শাহ কে ছিলেন? পাঠ্য লালন গীতিকা অবলম্বনে মূল বিষয়টি ব্যাখ্যা কর। 

উত্তর: লালন ফকির ছিলেন এক অনন্য সাধক, যিনি আধ্যাত্মিকতা, সমাজ সংস্কার এবং মানবতাবাদের সমন্বয়ে এক নতুন ধারা সৃষ্টি করেছিলেন। বাউল গানের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচয়িতা হিসেবে তিনি মানুষকে উপলব্ধির এক গভীর দিগন্তে পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন। তাঁর দর্শনের মূল প্রতিপাদ্য ছিল মানবতাকে শ্রেষ্ঠ সাধনা হিসেবে গ্রহণ করা।

তিনি বিশ্বাস করতেন, প্রকৃত মানুষ হতে হলে অন্য মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। মানুষের সান্নিধ্য ছাড়া অন্তরের সত্যিকারের মানুষকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। মানবসত্তার গভীরে বিরাজমান সেই ‘মনের মানুষ’-এর সন্ধান পেতে হলে আত্মজিজ্ঞাসা এবং গুরু-অনুগ্রহ অপরিহার্য। তাঁর মতে, মানুষের শরীরেই লুকিয়ে আছে সেই সহজ সত্য, যা ঠিক লতার মতো অন্তরালে বিরাজমান। যিনি এই সত্যকে উপলব্ধি করতে পারেন, তিনিই প্রকৃত মুক্তির পথ খুঁজে পান।

অতএব, লালনের মতে, মানুষের সেবা এবং মানবতাবাদী চেতনা ধারণ করাই পরম ত্রাণের উপায়। তিনি মনে করতেন, জাতিভেদ বা বাহ্যিক পরিচয় নয়, বরং মানুষের প্রতি ভালোবাসা ও সহমর্মিতাই জীবনের প্রকৃত সাধনা।

৩."আমরা তো অল্পে খুশি" - কারা, কেন অল্প খুশি? তাদের জীবনযাত্রার পরিচয় দাও।

উত্তর: জয় গোস্বামীর নুন কবিতাটি নিছক কাব্যিক সৌন্দর্যের বাহক নয়, বরং সমাজের নির্দিষ্ট একটি শ্রেণির বাস্তব জীবনসংগ্রামের আখ্যান। এখানে উঠে এসেছে সমাজের সেই দরিদ্র শ্রেণির কথা, যারা জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিনিয়ত দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকে। কবিতাটি তাদের জীবনযাত্রার এক নিখুঁত প্রতিচিত্র।

দরিদ্র শ্রেণির জীবনপ্রণালী

১) অনাড়ম্বর জীবনযাপন:
তাদের জীবন সম্পূর্ণ বাহুল্যবর্জিত। জীবনযাত্রার মূল লক্ষ্য শুধু খেয়ে পরে টিকে থাকা। খুব সাধারণভাবে, “সাধারণ ভাতকাপড়ে” তাদের দিন কেটে যায়।

২) অল্পতেই তুষ্ট:
অভাব-অনটন সত্ত্বেও তারা সহজেই খুশি হতে পারে। দুঃখ তাদের নিত্যসঙ্গী, তবু তারা হাসিমুখে বলে— "কী হবে দুঃখ করে?"

৩) সঞ্চয়হীন জীবন:
তারা প্রতিদিন কঠোর পরিশ্রম করে জীবিকা নির্বাহ করে, কিন্তু উপার্জিত অর্থ কেবলই দিন গুজরানের জন্য। সঞ্চয় গড়ে তোলার সামর্থ্য তাদের নেই। অসুস্থ হলে খাবারের অভাব হয়, আর চিকিৎসার জন্য ধার-দেনার ফাঁদে পড়তে হয়।

৪) হিসাবহীন ব্যয়:
কখনো ভাগ্যের চাকা ঘুরলে বা হাতে কিছু বেশি টাকা এলে তারা তা সঞ্চয় না করে আনন্দে উড়িয়ে দেয়। ‘মাত্রাছাড়া’ বাজার করে কিংবা গোলাপের চারা কিনে ঘরে ফেরে, যা তাদের স্বতঃস্ফূর্ত জীবনের প্রতিচ্ছবি।

৫) নেশার প্রবণতা:
দৈনন্দিন দুঃখ-যন্ত্রণার ভার কিছুটা লাঘব করতে অনেকেই আসক্ত হয়ে পড়ে মাদকে। নেশার ঘোরে কখনো তারা নিজেরাই ভুলে যায় বাস্তবতার কষাঘাত, হারিয়ে ফেলে যুক্তির ভারসাম্য।

৬) সংযমের অভাব:
রাতে খাবার সময় যদি ঠান্ডা ভাতের সঙ্গে নুন না থাকে, তবে তাদের রাগ ক্ষোভে পরিণত হয়। মুহূর্তে চিৎকার-চেঁচামেচি করে পাড়া গরম করে ফেলে। কে কী ভাবলো, তা নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই।

৭) বিদ্রোহী মনোভাব:
অত্যন্ত সীমিত জীবনযাপনের মধ্যেও ন্যূনতম চাহিদার অভাব তাদের বিদ্রোহী করে তোলে। তারা সমাজ ও প্রশাসনের কাছে প্রশ্ন তোলে— “আমাদের শুকনো ভাতে অন্তত লবণের ব্যবস্থা করো।”

৪. "আমাদের শুকনোভাতে লবণের ব্যবস্থা হোক।" - কারা, কাদের কাছে এই দাবি করেছে? এই দাবি কতটা যুক্তিসঙ্গত?

অথবা,

"আমাদের শুকনোভাতে লবণের ব্যবস্থা হোক।" - এই উক্তির তাৎপর্য লেখ।

উত্তর: জয় গোস্বামীর নুন কবিতায় সমাজের হতদরিদ্র শ্রমজীবী মানুষের জীবনসংগ্রামের প্রতিধ্বনি শোনা যায়। কথকের আকুতি— “আমাদের শুকনো ভাতে লবণের ব্যবস্থা হোক।” এটি কোনো দয়ার আবেদন নয়, বরং মৌলিক মানবাধিকারের ন্যায্য দাবি।

ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার ফলে সমাজে সম্পদের অসম বণ্টন চরম আকার ধারণ করেছে। পরিশ্রমী দরিদ্র মানুষের শ্রমজাত সম্পদ ধনীদের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়, ফলে তারা আরও বিত্তশালী হয়, আর গরিবরা আরও নিঃস্ব হয়ে পড়ে। তাদের আয় অনিয়মিত, জীবন চলে ধারদেনায়। কখনো বাজার করার সামর্থ্য থাকে না, ফলে একমুঠো শুকনো ভাতই শেষ ভরসা। কিন্তু যখন সেই ভাতের সঙ্গেও নুন থাকে না, তখন ক্ষুধা ও হতাশা তাদের মধ্যে হতাশা, রাগ ও অস্থিরতা তৈরি করে, যা কখনো চিৎকার-চেঁচামেচিতে রূপ নেয়। পরে তারা নিজেরাই অনুতপ্ত হয়, কিন্তু বাস্তবতা বদলায় না।

এই দরিদ্র মানুষেরা করুণা নয়, বরং তাদের ন্যায্য অধিকার চায়। অন্তত যেন তাদের একবেলার খাবারের সঙ্গে নুনটুকুর নিশ্চয়তা থাকে। সমাজ ও প্রশাসনের উচিত তাদের ন্যূনতম মৌলিক চাহিদা পূরণের দায়িত্ব নেওয়া।

                        নাটক:

১. ‘আগুন’ নাটকের নামকরণের সার্থকতা বিচার কর।

উত্তর: বিজন ভট্টাচার্যের ‘আগুন’ নাটকটি খাদ্যসংকট, দারিদ্র্য ও সামাজিক বৈষম্যের চিত্র তুলে ধরে। স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলায় সাধারণ মানুষ ক্ষুধার আগুনে দগ্ধ হচ্ছিল, যা নাটকের বিভিন্ন দৃশ্যে ফুটে উঠেছে।

প্রথম দৃশ্যে দেখা যায়, এক কৃষক তার কিশোর সন্তানকে ভোরে রেশন লাইনে পাঠায়। দ্বিতীয় ও তৃতীয় দৃশ্যে অন্য কৃষক ও শ্রমিক পরিবারগুলোর একইরকম সংগ্রাম ফুটে ওঠে। চতুর্থ দৃশ্যে, নানা ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মানুষ খাদ্যের আশায় লাইনে দাঁড়িয়ে থাকে।

এই সংকটময় মুহূর্তে এক যুবক চিৎকার করে ওঠে— “আগুন, আগুন!” সবাই ভাবে কোথাও আগুন লেগেছে, কিন্তু সে বলে, “আগুন লেগেছে আমাদের পেটে।” এখানে ‘আগুন’ প্রতীকীভাবে ক্ষুধা, বঞ্চনা ও দারিদ্র্যের আগুনকে বোঝায়।

নাটকের মূল প্রতিপাদ্যকে স্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তোলার কারণে ‘আগুন’ নামটি অত্যন্ত অর্থবহ, যথাযথ ও সার্থক।

২. ‘আগুন’ নাটকের চতুর্থ দৃশ্যে হরে কৃষ্ণ ও মনোরমার সংলাপের মাধ্যমে যে চিত্র ফুটে উঠেছে, তা নিজের ভাষায় লেখ।

উত্তর: বিজন ভট্টাচার্যের ‘আগুন’ নাটকে খাদ্যসংকট কেবল শ্রমজীবী ও কৃষক পরিবারগুলোর সমস্যা নয়, মধ্যবিত্তরাও এই দুর্ভোগের শিকার। চতুর্থ দৃশ্যে হরেকৃষ্ণ ও মনোরমার সংলাপের মাধ্যমে মধ্যবিত্ত জীবনের অসহায় বাস্তবতা গভীরভাবে ফুটে উঠেছে।

দৃশ্যের বর্ণনা

সকালের দিকে এক মধ্যবিত্ত কেরানি হরেকৃষ্ণবাবু ও তাঁর স্ত্রী মনোরমার মধ্যে কথোপকথন চলে। সংসারে অভাব চরমে উঠেছে, যা হরেকৃষ্ণবাবুর সংলাপে স্পষ্ট— “চা নেই, চিনি নেই, চাল নেই, খালি আছে চুলোটা।” অথচ মনোরমা তাঁকে চাল সংগ্রহের লাইনে দাঁড়াতে অনুপ্রাণিত করে।

কিন্তু হরেকৃষ্ণবাবু এক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি— রেশনের লাইনে দাঁড়ালে চাল পেতে অনেক সময় লেগে যাবে, অথচ তাঁকে দশটার মধ্যে অফিসে পৌঁছাতেই হবে। এরই মধ্যে অফিসের ম্যানেজার ও তার অনুগামীরা বরাদ্দ চাল কালোবাজারে বিক্রি করে দেয়, ফলে সাধারণ কর্মচারীরা বঞ্চিত হয়।

অসহায়তার প্রতিচ্ছবি

এই দৃশ্যের মাধ্যমে শুধু খাদ্যসংকটই নয়, মধ্যবিত্ত শ্রেণির অসহায়তা, দোটানা ও প্রশাসনিক দুর্নীতিও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তবুও মনোরমা স্বামীর মনে আশার সঞ্চার করে এবং তাকে ঠাকুরকে নমস্কার করে বেরিয়ে পড়তে বলে।

এভাবে হরেকৃষ্ণ ও মনোরমার সংলাপ ‘আগুন’ নাটকের মূল ভাবনাকে শক্তিশালী করে তোলে— যেখানে ক্ষুধার আগুন শুধু গরিবদের নয়, মধ্যবিত্তদের জীবনকেও দগ্ধ করছে।

          পূর্ণাঙ্গ সহায়ক গ্রন্থ:

১. মার্ক টোয়েনের লাইব্রেরি বিশেষত কী ছিল? আন্দ্রে জিদে কিভাবে তার লেখক বন্ধুদের শিক্ষা দিয়েছিলেন?

উত্তর: 👉 মার্ক টোয়েনের লাইব্রেরি: মার্ক টোয়েন ছিলেন একজন কৌতুকপ্রবণ ও ব্যঙ্গাত্মক লেখক, যার সাহিত্যিক দক্ষতা তার বিশাল লাইব্রেরির বইপত্র থেকে গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিল। তার ব্যক্তিগত গ্রন্থাগার ছিল বিভিন্ন বিষয়ের বইয়ে পরিপূর্ণ, যার মধ্যে ক্লাসিক সাহিত্য, ইতিহাস, বিজ্ঞান, ভূগোল, ধর্মতত্ত্ব, ব্যঙ্গাত্মক রচনা, এবং আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ অন্তর্ভুক্ত ছিল।

তার লাইব্রেরির গুরুত্বপূর্ণ বইগুলোর মধ্যে ছিল শেকসপিয়রের নাটকসমূহ, হোমারের Iliad, প্লুটার্কের জীবনীগ্রন্থ, চার্লস ডারউইনের On the Origin of Species, এবং বিভিন্ন আমেরিকান ও ব্রিটিশ লেখকের সাহিত্যকর্ম।

👉 আন্দ্রে জিদে ও তার লেখক বন্ধুদের শিক্ষা: আন্দ্রে জিদ ছিলেন আধুনিক ফরাসি সাহিত্যের অন্যতম পথিকৃৎ, যিনি সাহিত্যিক মুক্তচিন্তা ও মৌলিকতার ওপর জোর দিয়েছিলেন। তিনি মনে করতেন, একজন লেখকের কাজ হলো প্রচলিত ধারা ও সমাজের বাধাগুলো ভেঙে সত্য অনুসন্ধান করা। তিনি তার লেখক বন্ধুদের আত্ম-অন্বেষণে উৎসাহিত করতেন এবং তাদের বলতেন, তারা যেন প্রচলিত নৈতিকতা ও সাহিত্যিক কাঠামোর বাইরে গিয়ে নতুন কিছু সৃষ্টির চেষ্টা করে।

জিদে বিশেষভাবে ব্যক্তিস্বাধীনতা ও অন্তর্দ্বন্দ্বের বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিতেন। তিনি তরুণ লেখকদের সাহিত্যিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরামর্শ দিতেন এবং তাদের বলতেন, সাহিত্যের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত ব্যক্তি-অভিজ্ঞতার গভীরে প্রবেশ করা। তার এই দর্শন জ্যঁ-পল সার্ত্র ও অ্যালবার্ট কাম্যুর মতো অস্তিত্ববাদী লেখকদের ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল।

২.‘আজব শহর কলকাতা’ প্রবন্ধে ফরাসি বইয়ের দোকান দেখে লেখকের মনে কিরূপ ভাবের উদয় হয়েছিল? দোকানের ভিতর ঢুকে লেখক কিরূপ অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করলেন? 

উত্তর: বৃষ্টির হাত থেকে রেহাই পেতে ব্যস্ত লেখকের নজর পড়ে বড়ো হরফে লেখা "ফ্রেঞ্চ বুক শপ"। প্রথমে তিনি মনে করেন, কোনো পথভ্রষ্ট ফরাসি ব্যক্তি কলকাতায় এসে বইয়ের দোকান খুলেছেন, বা এটি শুধুই নামমাত্র ফরাসি, ভেতরে বাংলা বইয়ে ঠাসা।

কিন্তু দোকানে ঢুকে তিনি অবাক হয়ে দেখেন, সেখানে সত্যিই শুধুই ফরাসি বই। দোকানে বসা এক ফরাসি মেমসাহেব ফরাসিতে জানতে চান, তিনি কী খুঁজছেন। দীর্ঘদিন অনুশীলন না থাকায় লেখকের ফরাসিতে কথা বলতে দ্বিধা হয়, কিন্তু ইংরেজিতে বললেও মেমসাহেব ঠিকমতো বুঝতে পারেন না, তাই তিনি ফরাসিতেই কথা বলার অনুরোধ করেন।

লেখক অবশেষে ফরাসিতে কথা বলেন, মেমসাহেব তাঁর দক্ষতার প্রশংসা করেন। পরে জানা যায়, দোকানটি তাঁর এক বান্ধবীর, তিনি শুধু ফরাসি ভাষা ও সাহিত্য প্রচারের জন্য এখানে বসেন। এর মধ্যেই এক বাঙালি যুবক কমার্শিয়াল আর্টের বইয়ের সন্ধান করতে আসেন, আর লেখক ন্যুরেমবার্গের বিচার নিয়ে লেখা হিটলার-সম্পর্কিত একটি বই পেয়ে যান।

৩.‘পঁচিশে বৈশাখ’ প্রবন্ধে সৈয়দ মুজতবা আলী গান ছাড়া রবীন্দ্রনাথের কোন কোন গুণের কথা উল্লেখ করেছেন? তার কোবিদ গান অসম্পূর্ণ রূপে প্রতিভাত হয় না কেন?

উত্তর: সৈয়দ মুজতবা আলী তাঁর ‘পঁচিশে বৈশাখ’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান নিয়ে বিশদ আলোচনা করলেও প্রবন্ধের সূচনাতেই কবিগুরুর অন্যান্য সাহিত্যকর্মের প্রতি আলোকপাত করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, রবীন্দ্রনাথ যেমন উপন্যাস রচনায় অনন্য, তেমনি ছোটোগল্পের ক্ষেত্রেও মপাসাঁ ও চেখফের তুলনায় স্বতন্ত্র উচ্চতায় অবস্থান করেন। নাটকের ক্ষেত্রে তাঁর রচনাগুলোর সঙ্গে যে-কোনো মিস্টিক নাট্যকারের তুলনা করা যায়। কবি হিসেবে তো তিনি বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত।

শব্দতত্ত্বে তাঁর গভীর জ্ঞান, দার্শনিক ভাবনায় তাঁর অন্তর্দৃষ্টি এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষণে তাঁর দূরদর্শিতা পাঠককে নিত্য নতুন দিশা দেখিয়েছে। শিক্ষক ও পথপ্রদর্শক হিসেবে শান্তিনিকেতন গড়ে বিশ্বমানবতার এক অনন্য শিক্ষা-আশ্রম তৈরি করেছেন। ফলে, প্রবন্ধে কেবল রবীন্দ্রগানের আলোচনা নয়, বরং কবিগুরুর ঔপন্যাসিক, ছোটোগল্পকার, নাট্যকার, শব্দতাত্ত্বিক, দার্শনিক ও রাজনৈতিক দূরদর্শী সত্তারও চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।

রবীন্দ্রসঙ্গীত লেখকের মনে কখনোই অসম্পূর্ণ বলে মনে হয়নি। যদি কখনো কোনো গান শ্রোতার মনে অতৃপ্তি সৃষ্টি করে, তবে তার কারণ গানের অসম্পূর্ণতা নয়, বরং তার গভীরতা ও উচ্চাঙ্গের বৈশিষ্ট্য। রবীন্দ্রনাথের গানে থাকা সূক্ষ্ম ভাব ও ব্যঞ্জনা অনেক সময় সম্পূর্ণরূপে উপলব্ধি করা কঠিন হয়। তাঁর গানের শব্দচয়ন, শব্দের বিন্যাস এবং সুরের মাধুর্য শ্রোতার মনে এমন এক অনুভূতির সৃষ্টি করে, যা গান শেষ হওয়ার পরও এক ধরনের অতৃপ্তির আবেশ রেখে যায়। এই অতৃপ্তিই গানের গভীরতা ও ব্যঞ্জনার বৈশিষ্ট্য। লেখকের মতে, রবীন্দ্রনাথের গান নিজস্ব এক অনন্য পরিপূর্ণতায় পৌঁছায়, যা অন্য কোনো রূপ নিতে পারত না। এই গান শ্রোতা ও গায়কের মনে নতুন এক জগৎ সৃষ্টি করে, যা একবার অনুভব করলে ভোলার নয়।

৪. "বাড়ির আড্ডায় মেল মেলেনা" - এরূপ উক্তির কারণ কী? লেখক কোথায়, কাদের সঙ্গে আড্ডা দিতেন?

উত্তর: সৈয়দ মুজতবা আলী তাঁর ‘আড্ডা’ নিবন্ধে উল্লেখ করেছেন যে, কায়রোর আড্ডা কখনোই ব্যক্তিগত বাড়িতে বসত না। কারণ, আড্ডার স্বতন্ত্রতা ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ বাড়ির আড্ডায় বজায় থাকত না। যেহেতু বাড়ির মালিক সকলকে আপ্যায়ন করতেন, তাই তাঁকে অতিরিক্ত সমীহ করা হতো, যা আড্ডার প্রকৃত আনন্দ নষ্ট করত। তাই অভিজ্ঞ আড্ডাবাজদের মতে, বাড়ির পরিবেশ আড্ডার স্বাভাবিক উন্মুক্ততাকে ব্যাহত করত।

লেখকদের আড্ডার মূল কেন্দ্র ছিল ‘কাফে দ্য নীল’ বা ‘নীলনদ কাফে’। সেখানে নানা পটভূমির মানুষ একত্রিত হতেন। রমজান বে ও সাজ্জাদ এফেন্দি ছিলেন খাঁটি মিশরীয় মুসলমান। ওয়াহহাব আতিয়া ছিলেন কপ্টিক খ্রিস্টান এবং নিজেকে খাঁটি মিশরীয় বলে দাবি করতেন, কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন তাঁর শিরায় প্রবাহিত হচ্ছে ফ্যারাওদের রক্ত। সেখানে এক ফরাসি সাংবাদিকও ছিলেন, যিনি আরবি ভাষায় বীরত্বব্যঞ্জক কবিতা লিখতেন। আরেকজন ছিলেন গ্রিক বংশোদ্ভূত মার্কোস, যিনি দাবি করতেন, তাঁদের পরিবার প্রায় আড়াই হাজার বছর ধরে মিশরে বসবাস করছে এবং রানি ক্লিয়োপেট্রার সঙ্গে তাঁদের আত্মীয়তার সম্পর্ক রয়েছে।

এই বৈচিত্র্যময় গোষ্ঠীর সঙ্গে বাংলার জমিদারবাড়ি ও চণ্ডীমণ্ডপের আড্ডার একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে লেখক সৈয়দ মুজতবা আলী নিজেও যুক্ত হয়েছিলেন, যেখানে আড্ডা ছিল এক প্রাণবন্ত সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন।

আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ধারা:

১. বাংলা গদ্যের বিকাশে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান আলোচনা কর।

উত্তর: ঊনবিংশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মনীষী ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে বাংলা গদ্যের প্রথম প্রকৃত শিল্পী বলা হয়। তাঁর সাহিত্যকীর্তিকে বিভিন্ন শ্রেণিতে ভাগ করে বিশ্লেষণ করা যায়।

১. অনুবাদ সাহিত্য:
বিদ্যাসাগরের অনুবাদগ্রন্থগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো— বেতাল পঞ্চবিংশতি, অভিজ্ঞানশকুন্তলম, ভ্রান্তিবিলাস, বোধোদয়, কথামালা, সীতার বনবাস ও বাংলার ইতিহাস। এইসব অনুবাদ বাংলা গদ্যকে সমৃদ্ধ করেছে এবং তার শৈল্পিক কাঠামোকে সুদৃঢ় করেছে।

২. সমাজ সংস্কারমূলক রচনা:
সমাজ পরিবর্তনের লক্ষ্যে তিনি রচনা করেন বিধবা বিবাহ চালু হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব ও বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক বিচার। এই লেখাগুলোর মাধ্যমে তিনি সমাজের রূঢ় প্রথার বিরুদ্ধে যুক্তিনিষ্ঠ প্রতিবাদ গড়ে তোলেন।

৩. শিক্ষামূলক রচনা:
শিক্ষাক্ষেত্রে বিদ্যাসাগরের অবদান অপরিসীম। বর্ণপরিচয়, কথামালা, চরিতাবলী ও আখ্যান মঞ্জরী—এসব গ্রন্থ বাংলা ভাষা শিক্ষার ক্ষেত্রে যুগান্তকারী ভূমিকা রাখে।

৪. হাস্যরসাত্মক রচনা:
তিনি ছদ্মনামে লিখেছেন কিছু ব্যঙ্গধর্মী রচনা, যেমন—অতি অল্প হইল, আবার অতি অল্প হইল, ব্রজবিলাস ও রত্ন পরীক্ষা, যা বিদ্যাসাগরের ভাষার ব্যঙ্গাত্মক শক্তির প্রমাণ দেয়।

৫. মৌলিক সাহিত্য:
তাঁর মৌলিক রচনার মধ্যে অন্যতম সংস্কৃত ভাষা ও সংস্কৃত সাহিত্য বিষয়ক প্রস্তাব, যেখানে ভাষা ও সাহিত্যের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করা হয়েছে। বিদ্যাসাগর চরিত তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনী, আর প্রভাবতী সম্ভাষণ হলো তাঁর এক শোকগাথা।

বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্যকে এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দেন। সাধু গদ্যের শৈল্পিকতা ও সৌন্দর্য তাঁর হাতেই বিকশিত হয়। ভাষার শক্তি ও অলঙ্কারকে তিনি সুসমন্বিত করেন এবং গদ্যের কাঠামোতে যুক্তির শৃঙ্খলা ও শৈলী স্থাপন করেন।

২. বাংলা কাব্যে জীবনানন্দ দাশের অবদান সম্পর্কে লেখ।

অথবা,

‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ কার লেখা? তার কাব্য প্রতিভা আলোচনা কর।

উত্তর: জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪) রবীন্দ্র-উত্তর বাংলা কবিতার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি। বরিশালে জন্ম নেওয়া এই কবির পিতা সত্যানন্দ দাশ এবং মাতা কুসুমকুমারী দাশ। ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক হিসেবে কর্মজীবন কাটালেও কবিতাই ছিল তাঁর প্রকৃত পরিচয়। ১৯৫৪ সালে এক ট্রাম দুর্ঘটনায় তিনি মারা যান।

সাহিত্যকর্ম:

তাঁর প্রথম প্রকাশিত কবিতা বর্ষা আহ্বান। জীবদ্দশায় প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থগুলোর মধ্যে ঝরাপালক (১৯২৮), ধূসর পাণ্ডুলিপি (১৯৩৬), বনলতা সেন (১৯৪২) উল্লেখযোগ্য। মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয় রূপসী বাংলা (১৯৫৭) ও বেলা-অবেলা-কালবেলা (১৯৬১)।

বৈশিষ্ট্য ও অবদান:

• প্রকৃতির নিখুঁত চিত্রকল্প তৈরিতে তিনি অসাধারণ। তাঁর কবিতায় ঘ্রাণ, রঙ, স্পর্শ—সবকিছু অনুভূত হয়।
• রবীন্দ্রনাথের মতে, তাঁর কবিতার প্রধান বৈশিষ্ট্য “চিত্ররূপময়তা”।
• সংক্ষিপ্ত অথচ গভীর চিত্রকল্পের জন্য অনেকেই তাঁকে দুর্বোধ্য বলে মনে করেন।
• বাংলা কবিতায় পরাবাস্তববাদ ও ইতিহাসচেতনার সমন্বয় ঘটিয়েছেন তিনি।
• যন্ত্রসভ্যতার কুশ্রীতা ও যুদ্ধের ভয়াবহতায় তিনি ব্যথিত হলেও তাঁর কবিতায় রোমান্টিকতা ও প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা স্পষ্ট।

উপসংহার:

মোহিতলাল, নজরুল, এলিয়টের প্রভাব থাকলেও জীবনানন্দ নিজস্ব শৈলী গড়ে তুলেছেন। বাংলা কবিতায় মুখের ভাষার ব্যবহার, গদ্যকবিতার প্রচলন এবং নতুন ছন্দের প্রয়োগে তাঁর অবদান অনন্য।

৩. উপন্যাসিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সম্পর্কে আলোচনা কর।

উত্তর: শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৭৬-১৯৩৮) বাংলা কথাসাহিত্যের এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী নাম। তিনি সাধারণ মানুষের জীবন, প্রেম, সামাজিক কুসংস্কার ও নারীর অবস্থানকে নিখুঁতভাবে তুলে ধরেছেন। তাঁর সাহিত্য সহজ ভাষায় রচিত হওয়ায় পাঠকের হৃদয়ে আজও সমান জনপ্রিয়।

শরৎচন্দ্রের উপন্যাসে নারী চরিত্র বিশেষভাবে উজ্জ্বল। দেবদাস-এর পার্বতী, দেনাপাওনা-এর ষোড়শী, গৃহদাহ-এর অচলা, চরিত্রহীন-এর কিরণময়ী—এঁরা সবাই সমাজের প্রতিকূল পরিবেশে থেকেও নিজেদের ভালোবাসা ও আত্মমর্যাদার জন্য সংগ্রাম করেছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে বড়দিদি, বিরাজবৌ, পরিণীতা, মেজদিদি, দত্তা, চরিত্রহীন, শ্রীকান্ত, গৃহদাহ, দেবদাস, দেনাপাওনা, পথের দাবী ও শেষ প্রশ্ন।

শরৎচন্দ্র সমাজের অন্যায়-অবিচার, কুসংস্কার ও সংকীর্ণতার বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। চরিত্রহীন-এ তিনি সতীত্বের প্রচলিত ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করেছেন, পথের দাবী-তে বিপ্লবের আহ্বান জানিয়েছেন। তাঁর সাহিত্য কেবল প্রেমের নয়, সমাজ পরিবর্তনেরও প্রতিচ্ছবি।

বাস্তব জীবনের সত্যকে শিল্পরূপ দেওয়ার অসাধারণ ক্ষমতার জন্য শরৎচন্দ্র বাংলা উপন্যাস সাহিত্যে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছেন। সহজ ভাষা ও হৃদয়স্পর্শী কাহিনির জন্য তাঁর সাহিত্য আজও পাঠকের মনে স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছে।

৪. বিহারীলাল চক্রবর্তীকে ‘ভোরের পাখি’ অভিধায় কে, কেন অভিহিত করেন? গীতি কবিতার ধারায় কবি বিহারীলাল চক্রবর্তীর অবদান আলোচনা কর।

উত্তর: বিহারীলাল চক্রবর্তী (১৮৩৫-১৮৯৪) বাংলা গীতিকবিতার অন্যতম পথপ্রদর্শক। ২১ মে, ১৮৩৫ সালে কলকাতার জোড়াবাগানে জন্ম নেওয়া এই কবি বাংলার কাব্যজগতে এক নতুন ধারা সৃষ্টি করেন। তাঁর হাত ধরেই বাংলা গীতিকবিতায় স্বতন্ত্র রোমান্টিক ভাবধারা প্রসার লাভ করে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে ‘ভোরের পাখি’ বলে অভিহিত করেছেন, কারণ তিনি বাংলা কবিতার আবেগময় কল্পনার প্রথম সংবাদবাহক।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর সম্পর্কে বলেন, “বিহারীলাল তখনকার ইংরেজি শিক্ষায় দীক্ষিত কবিদের মতো যুদ্ধ বা দেশাত্মবোধক কবিতা লেখেননি। তিনি একান্তভাবে নিজস্ব ছন্দে মনের কথা বলেছেন, যা সরাসরি পাঠকের হৃদয়ে প্রবেশ করে।”

বাংলার নবজাগরণকালে মধুসূদনের কাব্যে বিদ্রোহের যে তীব্র প্রকাশ ছিল, বিহারীলালের কাব্যে তা রূপ পেয়েছে কোমল অনুভবে। তাঁর কবিতায় আত্মচিন্তার গভীরতা ও স্বতঃস্ফূর্ত আবেগের প্রকাশ ঘটেছে, যা বাংলা গীতিকাব্যকে এক নতুন দিগন্তে পৌঁছে দিয়েছে। সেই কারণেই তিনি বাংলা গীতিকবিতার প্রথম প্রকৃত রোমান্টিক কবি এবং আধুনিক কাব্যের ‘ভোরের পাখি’ হিসেবে চিরস্মরণীয়।

৫. ‘নীলদর্পণ’ নাটকের নাট্যকার ও ইংরেজি অনুবাদকের নাম লেখ। নাটকটির প্রভাব উল্লেখ কর।

উত্তর: ‘নীলদর্পণ’ নাটকটি রচনা করেন দীনবন্ধু মিত্র (১৮৩০-১৮৭৩)। এই নাটকটি ১৮৬০ সালে প্রকাশিত হয় এবং ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করেন মাইকেল মধুসূদন দত্তের সহযোগিতায় রেভারেন্ড জেমস লঙ।

নাটকটির প্রভাব:

‘নীলদর্পণ’ ব্রিটিশ শাসনামলে বাংলার নীলচাষিদের দুর্দশা ও অত্যাচারের বাস্তবচিত্র তুলে ধরে। নাটকটি প্রকাশের পর সমাজে গভীর আলোড়ন সৃষ্টি হয়। এর মাধ্যমে নীলকরদের শোষণ ও নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে জনসচেতনতা বাড়ে এবং ব্রিটিশ শাসনের কঠোর সমালোচনা শুরু হয়।

এই নাটকের ইংরেজি অনুবাদ ব্রিটিশ প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে, যার ফলে অনুবাদক জেমস লঙকে ব্রিটিশ সরকার কারাদণ্ড ও জরিমানা প্রদান করে। পরে কালীপ্রসন্ন সিংহ তাঁর জরিমানার টাকা পরিশোধ করেন।

‘নীলদর্পণ’ নাটকটি ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে অনুপ্রাণিত করে এবং পরবর্তী কালে বাংলার কৃষক বিদ্রোহ ও নীলকর আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এটি বাংলা নাট্যসাহিত্যের এক মাইলফলক এবং সামাজিক বাস্তবতাকে তুলে ধরার অন্যতম শ্রেষ্ঠ উদাহরণ।

৬. লোককথার সংজ্ঞা নির্দেশ করে বিভিন্ন প্রকার লোককথার সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।

উত্তর: লোককথা হলো সেইসব কাহিনি, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে মৌখিকভাবে প্রচারিত হয়ে এসেছে এবং কোনো নির্দিষ্ট লেখকের সৃষ্টি নয়। এটি সাধারণ মানুষের জীবন, সংস্কৃতি, কল্পনা ও বিশ্বাসের প্রতিফলন ঘটায়।

লোককথার বিভিন্ন প্রকার

১. রূপকথা: কাল্পনিক ও অলৌকিক ঘটনাবলী নিয়ে গঠিত কাহিনি। যেমন— ঠাকুরমার ঝুলি, সাত ভাই চম্পা।
২. পরী-কথা: পরীদের নিয়ে গঠিত কাহিনি, যেখানে জাদু ও অলৌকিক ঘটনা থাকে। যেমন— আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ।
৩. গল্পকথা: দৈনন্দিন জীবনের হাস্যরসপূর্ণ ও শিক্ষামূলক কাহিনি। যেমন— গোপাল ভাঁড়ের গল্প।
৪. থাকথা: অতীতের কোনো ঘটনার ভিত্তিতে গঠিত কাহিনি, যা লোকমনে প্রচলিত।
৫. দৈবকথা বা পুরাণকথা: দেবতা, দৈত্য-দানব ও সৃষ্টিতত্ত্ব সম্পর্কিত কাহিনি। যেমন— মনসামঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল।
৬. জনশ্রুতি: নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা স্থানের সম্পর্কে প্রচলিত লোককথা, যা কল্পনা ও বাস্তবতার সংমিশ্রণ।

লোককথা একটি জাতির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারক, যা সমাজের নৈতিক শিক্ষা ও বিনোদনের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম।

 

<<<<<<<<<<<<<🌹 সমাপ্ত 🌹>>>>>>>>>>>>>