🌹বি.এ বাংলা মেজর-৩(পেপার-২)::ভাষাতত্ত্ব:: সেমিস্টার-৩:: সাজেশন(পার্ট-২)🌹

 

 

 

✍️প্রশ্নের মান-৫:

১. গঠন অনুসারে বাক্য কয় প্রকার ও কি কি? উদাহরণসহ আলোচনা কর।

উঃ
গঠন অনুসারে বাক্য তিন প্রকার:
প্রথমত, সরল বাক্য – যে বাক্যে একটি মাত্র প্রধান ক্রিয়া থাকে এবং কোনো অতিরিক্ত উপবাক্য থাকে না, তাকে সরল বাক্য বলে। যেমন:

• রবি স্কুলে যায়।
• আমি বই পড়ি।

দ্বিতীয়ত, যৌগিক বাক্য – দুটি বা ততোধিক সরল বাক্য যখন সমন্বয় বা সংযোজন সন্ধির মাধ্যমে যুক্ত হয়, তখন তা যৌগিক বাক্য হয়। এতে দুটি বা তার বেশি প্রধান ক্রিয়া থাকে। যেমন:

• আমি পড়ি এবং সে লেখে।
• বৃষ্টি পড়ল, তাই আমি ছাতা নিলাম।

তৃতীয়ত, জটিল বাক্য – যে বাক্যে একটি প্রধান বাক্য এবং একটি বা একাধিক আশ্রিত বা অনুসারী উপবাক্য থাকে, তাকে জটিল বাক্য বলে। যেমন:

• যখন বৃষ্টি শুরু হলো, তখন আমরা ঘরে ফিরে এলাম।
• যেহেতু সে পরিশ্রমী, তাই সে সফল হবে।

গঠন অনুসারে বাক্যের এই প্রকারভেদ বাংলা ব্যাকরণের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বাক্যের ধরন সঠিকভাবে বোঝার মাধ্যমে লেখার দক্ষতা বৃদ্ধি পায় এবং ভাষা আরও সুস্পষ্ট ও গতিময় হয়।

২. সংস্কৃত ভাষা কি বাংলা ভাষার জননী আলোচনা কর।

উঃ বাংলা ভাষার উৎস ও বিকাশ নিয়ে ভাষাতাত্ত্বিকদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে আলোচনা চলছে। অনেকের মতে, সংস্কৃত ভাষা বাংলা ভাষার জননী হলেও, কিছু ভাষাতাত্ত্বিক মনে করেন, বাংলা ভাষার উৎপত্তিতে সংস্কৃতের পাশাপাশি প্রাকৃত ও অপভ্রংশ ভাষারও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।

সংস্কৃত ভাষা ও বাংলা ভাষার সম্পর্ক:

প্রথমত, ইন্দো-আর্য ভাষা থেকে উভয়ের উৎপত্তি – সংস্কৃত ও বাংলা ভাষা উভয়ই ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবারের ইন্দো-আর্য শাখার অন্তর্গত। তবে বাংলা ভাষার বিকাশ সরাসরি সংস্কৃত থেকে না হয়ে প্রাকৃত ও অপভ্রংশের মাধ্যমে হয়েছে।

দ্বিতীয়ত, সংস্কৃতের প্রভাব – বাংলা ভাষার শব্দভাণ্ডার, ব্যাকরণ ও উচ্চারণে সংস্কৃতের গভীর প্রভাব রয়েছে। যেমন, ‘পিতা’, ‘মাতা’, ‘গম’, ‘জল’ ইত্যাদি শব্দ সংস্কৃত থেকে এসেছে।

তৃতীয়ত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশের ভূমিকা – বাংলা ভাষার বিকাশে সংস্কৃতের পাশাপাশি মাগধী প্রাকৃত ও মাগধী অপভ্রংশের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এই ভাষাগুলো সংস্কৃতের জটিল ব্যাকরণ সরল করে সাধারণ মানুষের ভাষায় রূপান্তরিত করেছিল।

বাংলা ভাষার উদ্ভব ও বিকাশ:

প্রথম পর্যায়ে, প্রাকৃত ভাষা সংস্কৃতের তুলনায় অনেক সহজ ছিল এবং এটি সাধারণ মানুষের ভাষা হিসেবে প্রচলিত ছিল। দ্বিতীয় পর্যায়ে, অপভ্রংশ ভাষা প্রাকৃত থেকে উদ্ভূত হয়, যা পরবর্তীতে বাংলা ভাষার ভিত্তি স্থাপন করে।

সংস্কৃত কি বাংলা ভাষার জননী?

প্রথমত, সংস্কৃত বাংলা ভাষার উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে এবং তার শব্দভাণ্ডার সমৃদ্ধ করেছে।

দ্বিতীয়ত, বাংলা ভাষা সরাসরি সংস্কৃত থেকে উদ্ভূত নয়, বরং প্রাকৃত ও অপভ্রংশের মাধ্যমে বিকশিত হয়েছে।

তৃতীয়ত, বাংলা ভাষার বিকাশে ফারসি, আরবি, পর্তুগিজ, ইংরেজি প্রভৃতি ভাষারও প্রভাব রয়েছে।

উপসংহার:

বাংলা ভাষা সংস্কৃত থেকে সরাসরি এসেছে বলা ভুল হবে, তবে সংস্কৃত বাংলা ভাষার একটি প্রধান উৎস। বাংলা ভাষার বিকাশ সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশের সম্মিলিত প্রভাবের ফল। অতএব, সংস্কৃতকে বাংলা ভাষার একমাত্র জননী বলা সঠিক নয়, তবে এটি বাংলা ভাষার বিকাশে অন্যতম প্রধান উৎস।

৩. ধ্বনিমূল কাকে বলে? ধ্বনিমূল ও সহধ্বনির পার্থক্য লেখ।

উঃ 👉বাংলা ভাষার উচ্চারণগত বৈশিষ্ট্য বোঝার জন্য ধ্বনিতত্ত্বে দুটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা হলো ধ্বনিমূল ও সহধ্বনি।

ধ্বনিমূল কাকে বলে?

ধ্বনিমূল (Phoneme) হল ভাষার ক্ষুদ্রতম ধ্বনিগত একক, যা অর্থ পরিবর্তন করতে সক্ষম। এটি এমন একটি ধ্বনি যা কোনো শব্দের অর্থগত পার্থক্য সৃষ্টি করে। উদাহরণস্বরূপ, কাল ও বাল শব্দ দুটিতে "ক" ও "ব" দুটি ভিন্ন ধ্বনিমূল, কারণ এই পরিবর্তন অর্থ পরিবর্তন ঘটায়।

👉ধ্বনিমূল ও সহধ্বনির পার্থক্য:

বিষয়	ধ্বনিমূল	সহধ্বনি
সংজ্ঞা	ভাষার ক্ষুদ্রতম ধ্বনি, যা অর্থ পরিবর্তন করতে পারে।	ধ্বনিমূলের ভিন্নতর রূপ, যা অর্থ পরিবর্তন করে না।
উদাহরণ	‘তাল’ ও ‘কাল’ - এখানে ‘ত’ ও ‘ক’ ভিন্ন ধ্বনিমূল।	‘তাল’ শব্দের ‘ল’ উচ্চারণ বিভিন্নভাবে পরিবর্তিত হলেও অর্থ অপরিবর্তিত থাকে।
ধরন	এটি স্বতন্ত্র এবং শব্দ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।	এটি উচ্চারণভেদে পরিবর্তিত হতে পারে, তবে শব্দের অর্থ অপরিবর্তিত থাকে।
প্রভাব	শব্দের অর্থ পরিবর্তন করতে পারে।	উচ্চারণগত পরিবর্তন ঘটায়, তবে অর্থ পরিবর্তন করে না।

উপসংহার:

ধ্বনিমূল হলো ভাষার মৌলিক ধ্বনি, যা অর্থগত পার্থক্য সৃষ্টি করে, আর সহধ্বনি হলো ধ্বনিমূলের বিভিন্ন প্রকরণ, যা উচ্চারণের পার্থক্য তৈরি করে কিন্তু অর্থ পরিবর্তন করে না।

৪. রূপমূল কাকে বলে? রূপমূলের শ্রেণীবিভাগ কর।

উঃ রূপমূল (Morph) হল ভাষার একটি ক্ষুদ্রতম অর্থবোধক একক, যা শব্দের গঠন এবং রূপ পরিবর্তন নিয়ে কাজ করে। এটি এমন একটি মৌলিক একক, যা কোনো শব্দের অর্থ বা গঠনগত পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম। রূপমূল শব্দের মানে বা ব্যবহার পরিবর্তন না করে, তার ব্যাকরণিক রূপ তৈরি করে। উদাহরণস্বরূপ, ‘বই’ শব্দটি রূপমূল হিসেবে থাকলেও, ‘বইগুলি’, ‘বইয়ের’ ইত্যাদি রূপে পরিণত হতে পারে।

রূপমূলের শ্রেণীবিভাগ:

রূপমূল সাধারণত দুটি প্রধান শ্রেণিতে বিভক্ত হয়: মূলরূপ এবং অলংকৃত রূপ। তবে, এই শ্রেণীটি ভাষার বিভিন্ন ধাঁচ অনুসারে ভিন্ন হতে পারে।

১. মূলরূপ (Root Morpheme):
মূলরূপ হচ্ছে একটি রূপমূল যা কোনো রূপান্তর বা পরিবর্তন ছাড়াই শব্দের মূল অর্থ বহন করে। এটি একে এককভাবে ব্যবহার করা যায় এবং কোনো উপসর্গ বা প্রত্যয় ছাড়াই পূর্ণার্থ প্রদান করে। উদাহরণস্বরূপ:

• ‘গাছ’ (মূলরূপ)
• ‘পানি’ (মূলরূপ)

২. অলংকৃত রূপ (Derived Morpheme):
অলংকৃত রূপ হলো একটি রূপমূল যা উপসর্গ বা প্রত্যয় যোগ করার মাধ্যমে নতুন শব্দ বা অর্থ সৃষ্টি করে। উদাহরণস্বরূপ:

• ‘গাছগুলি’ (মূলরূপ ‘গাছ’ + বহুবচন নির্দেশক ‘গুলি’)
• ‘পানীয়’ (মূলরূপ ‘পানি’ + ‘য়’ প্রত্যয়)

এছাড়া, নির্বাচক রূপ এবং বন্ধনী রূপ সহ অন্যান্য শ্রেণীও কিছু ভাষাতত্ত্ববিদরা চিহ্নিত করেছেন, তবে মূলত দুইটি শ্রেণীই প্রধান: মূলরূপ এবং অলংকৃত রূপ।

উপসংহার:

রূপমূল ভাষার মৌলিক একক যা শব্দ গঠনের প্রক্রিয়া এবং তার অর্থ প্রকাশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। মূলরূপ এবং অলংকৃত রূপের মাধ্যমে ভাষায় শব্দের বৈচিত্র্য এবং অর্থের পরিসর সৃষ্টি হয়।

৫. উপভাষা কাকে বলে? ভাষা ও উপভাষার পার্থক্য লেখ।

উঃ উপভাষা (Dialect) হলো একটি ভাষার একটি আঞ্চলিক বা সামাজিক উপাদান, যা ভাষার প্রধান ধারা বা মূল গঠন থেকে কিছুটা ভিন্ন হতে পারে। এটি একটি ভাষার শাখা, যা নির্দিষ্ট অঞ্চলের মানুষদের মধ্যে ব্যবহৃত হয় এবং প্রধান ভাষার সঙ্গে সাংস্কৃতিক, ঐতিহ্যগত বা আঞ্চলিক পার্থক্য থাকতে পারে। উপভাষা মূলত ভাষার উচ্চারণ, শব্দচয়ন, বাক্যগঠন বা অন্যান্য ভাষাগত বৈশিষ্ট্যের পার্থক্য হতে পারে।

উপভাষা সাধারণত একটি বিশাল ভাষার অভ্যন্তরে তৈরি হয় এবং এটি এক বা একাধিক অঞ্চলের মধ্যে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, বাংলা ভাষার মধ্যে বিভিন্ন উপভাষা যেমন পূর্ববাংলা, পশ্চিমবাংলা, এবং বরিশাল অঞ্চলের উপভাষা রয়েছে।

ভাষা ও উপভাষার পার্থক্য:

১. অর্থের পার্থক্য:

• ভাষা: একটি ভাষা একটি পূর্ণাঙ্গ ভাষাগত সিস্টেম, যা তার নিজস্ব ব্যাকরণ, শব্দভাণ্ডার, উচ্চারণ ও অন্যান্য বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে গঠিত হয়। এটি একটি বৃহত্তর ভাষা সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্যবহৃত হয়।
• উপভাষা: উপভাষা একটি ভাষারই অংশ বা শাখা, যা প্রধান ভাষার একটি আঞ্চলিক বা সামাজিক বৈশিষ্ট্য। এটি একই ভাষার মধ্যে বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যবহৃত ভাষাগত পার্থক্য বা পরিবর্তন হতে পারে।

২. ব্যবহার এবং অঞ্চলের পার্থক্য:

• ভাষা: একটি ভাষা বৃহত্তর অঞ্চলে ব্যবহৃত হয় এবং একাধিক সম্প্রদায় বা জাতির মধ্যে প্রচলিত থাকতে পারে।
• উপভাষা: একটি ভাষার উপভাষা সাধারণত নির্দিষ্ট অঞ্চলের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে এবং একটি অঞ্চলের মানুষদের মধ্যে প্রাধান্য পায়।

৩. ভাষাগত বৈশিষ্ট্যের পার্থক্য:

• ভাষা: ভাষার গঠন, শব্দ, বাক্যগঠন, এবং উচ্চারণের একটি সুসংহত এবং প্রতিষ্ঠিত কাঠামো থাকে।
• উপভাষা: উপভাষার মধ্যে শব্দের ব্যবহার, উচ্চারণ এবং বাক্যগঠন ভিন্ন হতে পারে, তবে এটি মূল ভাষার সীমার মধ্যে থাকে। উদাহরণস্বরূপ, পশ্চিমবাংলা এবং পূর্ববাংলার বাংলা ভাষায় উচ্চারণের পার্থক্য থাকতে পারে।

৪. স্বীকৃতির পার্থক্য:

• ভাষা: একটি ভাষা সাধারণত সরকারি বা বৈশ্বিক স্বীকৃতি পায় এবং আন্তর্জাতিক বা দেশীয় প্রতিষ্ঠানে ব্যবহৃত হয়।
• উপভাষা: উপভাষা একটি ভাষার আঞ্চলিক শাখা হওয়ায়, এটি সাধারণত একটি আঞ্চলিক বা স্থানীয় স্বীকৃতি পায় এবং এর ব্যবহার মূল ভাষার অধীনে থাকে।

উপসংহার:

ভাষা এবং উপভাষার মধ্যে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। ভাষা একটি পূর্ণাঙ্গ এবং একক ভাষাগত কাঠামো, যেখানে উপভাষা ভাষার বিভিন্ন আঞ্চলিক বা সামাজিক সংস্করণ। উপভাষা ভাষার অভ্যন্তরে বিভিন্ন পার্থক্য তৈরি করে, যা মানুষের সামাজিক বা আঞ্চলিক পরিচয় এবং ভাষার বৈচিত্র্য প্রকাশে সাহায্য করে।