🌹বি.এ সেমিস্টার-১: ইতিহাস মেজর সাজেশন:পার্ট-৩🌹

✍️প্রশ্নের মান-১০:

১.ভারতীয় বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যের তাৎপর্য আলোচনা করো।

অথবা, ভারত “নৃতত্ত্বের যাদুঘর”-আলোচনা করো। 

উত্তর: ভূমিকা: ভারত বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন সভ্যতার কেন্দ্র এবং বৈচিত্র্যের এক অসাধারণ উদাহরণ। ভৌগোলিক, সাংস্কৃতিক, এবং ধর্মীয় দিক থেকে এটি একটি বিস্ময়কর দেশ, যেখানে শত শত বছর ধরে বিভিন্ন ভাষা, জাতি, ধর্ম, এবং সংস্কৃতি সহাবস্থান করে এসেছে। এখানকার ঐতিহ্য আমাদের শেখায়, কিভাবে ভিন্নতাকে স্বীকার করে একটি ঐক্যবদ্ধ জাতি গঠন করা যায়। এই কারণেই ভারতকে "বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের" মূর্ত প্রতীক এবং "নৃতত্ত্বের যাদুঘর" বলা হয়।

বৈচিত্র্যের বৈশিষ্ট্য:

• ভাষাগত বৈচিত্র্য: ভারতে ২২টি সংবিধান স্বীকৃত ভাষা এবং ১৬০০-এরও বেশি উপভাষা রয়েছে। প্রতিটি রাজ্যে ভিন্ন ভিন্ন ভাষা প্রচলিত, যেমন তামিল, বাংলা, পাঞ্জাবি, এবং মারাঠি।
• ধর্মীয় বৈচিত্র্য: হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান, শিখ, বৌদ্ধ, এবং জৈনসহ বিভিন্ন ধর্মের মানুষ এখানে বাস করে। প্রতিটি ধর্মের উৎসব, যেমন দীপাবলি, ঈদ, বড়দিন, এবং গুরুপরব, জাতীয় ঐক্যের প্রতীক।
• সংস্কৃতি ও জীবনধারা: ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের পোশাক, খাদ্যাভ্যাস, এবং নৃত্যশৈলীতে এর বৈচিত্র্য প্রতিফলিত হয়।

"বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য" ধারণার ভিত্তি:

• জাতীয় ঐক্যের প্রতীক: ভারতের জাতীয় পতাকা, সংগীত, এবং সংবিধান ভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে।
• ধর্মনিরপেক্ষতা: সংবিধান অনুযায়ী, প্রত্যেক নাগরিক সমান অধিকার পায়, যা সহনশীলতা এবং ভ্রাতৃত্ব বজায় রাখে।
• শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান: ভিন্ন সম্প্রদায় এবং জাতিগোষ্ঠী একত্রে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করে, যা জাতীয় ঐক্যের একটি মজবুত ভিত্তি।

ভারত "নৃতত্ত্বের যাদুঘর":

• জাতিগত বৈচিত্র্য: আর্য, দ্রাবিড়, এবং মঙ্গোলীয় জাতিগোষ্ঠীর সংমিশ্রণ ভারতের বৈচিত্র্যকে আরও সমৃদ্ধ করেছে।
• ভূগোলের বৈচিত্র্য: উত্তর ভারতের তুষারময় হিমালয় থেকে দক্ষিণের সমুদ্রসৈকত এবং রাজস্থানের মরুভূমি থেকে মেঘালয়ের বৃষ্টিবহুল অরণ্য—সবই ভারতের অনন্য বৈশিষ্ট্য।
• শিল্প ও সংস্কৃতি: ভরতনাট্যম, ভাংড়া, কথাকলি, এবং রবীন্দ্রনৃত্য ভারতের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের প্রভাব:

• এটি গণতন্ত্রের ভিত্তিকে শক্তিশালী করে।
• ভারতের বহুত্ববাদী সমাজে মানবিক মূল্যবোধের বিকাশ ঘটায়।
• এটি সমগ্র বিশ্বের কাছে শান্তি এবং সহাবস্থানের বার্তা পৌঁছে দেয়।

ভারত তার বৈচিত্র্যের মধ্যেই ঐক্য রক্ষা করে চলেছে, যা শুধু দেশের গর্ব নয়, সমগ্র বিশ্বের জন্য একটি আদর্শ। এ বৈচিত্র্যের মধ্যে নিহিত ঐক্য ভারতের প্রকৃত পরিচয় এবং শক্তির উৎস।

২.প্রাচীন প্রস্তর যুগের মানুষের জীবনযাত্রা ও কার্যকলাপের পরিচয় দাও।

উত্তর: ভূমিকা: প্রাচীন প্রস্তর যুগ (Paleolithic Age) মানব ইতিহাসের প্রাথমিক পর্যায়, যা প্রায় ২০ লক্ষ বছর পূর্বে শুরু হয় এবং প্রায় খ্রিস্টপূর্ব ১০,০০০ অবধি স্থায়ী ছিল। এই সময় মানুষ পাথরকে প্রধান হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করত, যা তাদের জীবনযাত্রা ও কার্যকলাপের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

জীবনযাত্রা:
প্রস্তর যুগের মানুষ যাযাবর ছিল এবং শিকার ও সংগ্রহ করে জীবন ধারণ করত। তারা সাধারণত গুহায় বা প্রাকৃতিক আশ্রয়ে বাস করত। আগুন আবিষ্কার এই সময়ের একটি উল্লেখযোগ্য অর্জন, যা তাদের শীত থেকে রক্ষা করা, খাদ্য রান্না, এবং বন্য প্রাণীদের হাত থেকে আত্মরক্ষা করতে সাহায্য করেছিল।

খাদ্য সংগ্রহ:
তারা প্রধানত ফল, মূল, কন্দ, বাদাম, এবং শিকারকৃত পশুর মাংস খেয়ে বেঁচে থাকত। খাবারের খোঁজে তারা এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ঘুরে বেড়াত।

হাতিয়ার নির্মাণ ও ব্যবহার:
প্রস্তর যুগের মানুষ তীক্ষ্ণ প্রান্তযুক্ত পাথরের হাতিয়ার তৈরি করত। এই হাতিয়ারগুলি শিকার, গাছ কাটা, এবং পশুর চামড়া সংগ্রহের কাজে ব্যবহৃত হত। পরবর্তীতে তারা পশুর হাড় এবং কাঠের তৈরি হাতিয়ারও ব্যবহার করতে শুরু করে।

অর্থনৈতিক কার্যকলাপ:
তারা একটি সাদামাটা অর্থনৈতিক ব্যবস্থা অনুসরণ করত, যা প্রধানত খাদ্য সংগ্রহ এবং প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারভিত্তিক ছিল। বিনিময় ব্যবস্থা বা কৃষি তখনও প্রচলিত হয়নি।

সামাজিক জীবন:
প্রস্তর যুগের মানুষ ছোট ছোট দল বা সম্প্রদায়ে বাস করত। তারা একসঙ্গে শিকার করত এবং খাবার ভাগাভাগি করত। এতে সামাজিক সহযোগিতা এবং সম্প্রীতি বজায় থাকত।

শিল্প ও ধর্ম:
প্রস্তর যুগের শেষদিকে (উত্তর প্রস্তর যুগ), মানুষ গুহার দেওয়ালে প্রাণীর ছবি আঁকতে শুরু করে। এগুলি তাদের শৈল্পিক দক্ষতার প্রথম নিদর্শন। এছাড়াও, প্রাকৃতিক শক্তির প্রতি ভয় এবং শ্রদ্ধা থেকেই ধর্মীয় বিশ্বাসের সূচনা হয়।

উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন:
প্রস্তর যুগের শেষে মানুষ কৃষি ও স্থায়ী বসতির দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। এই পরিবর্তন নবপলীয় যুগের সূচনা করে।

প্রাচীন প্রস্তর যুগ মানবজাতির ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। শিকার, সংগ্রহ, এবং পাথরের হাতিয়ার ব্যবহারের মাধ্যমে তারা বেঁচে থাকার নতুন নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিল, যা পরবর্তীতে মানব সভ্যতার ভিত্তি স্থাপন করে।

৩.হরপ্পা সভ্যতার নাগরিক জীবনের বৈশিষ্ট্য আলোচনা করো।

অথবা, সিন্ধু সভ্যতার মূল বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করো।

উত্তর: ভূমিকা: সিন্ধু সভ্যতা, যা হরপ্পা সভ্যতা নামেও পরিচিত, প্রাচীন পৃথিবীর অন্যতম উন্নত নগরসভ্যতা। এটি খ্রিস্টপূর্ব ২৬০০ থেকে ১৯০০ অবধি বর্তমান পাকিস্তান ও উত্তর-পশ্চিম ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বিকশিত হয়। এই সভ্যতা শহর পরিকল্পনা, স্যানিটেশন ব্যবস্থা, এবং শিল্পে তাদের অগ্রগতি দ্বারা পরিচিত। নিচে নাগরিক জীবনের প্রধান বৈশিষ্ট্য এবং সভ্যতার মূল দিকগুলি আলোচনা করা হলো:

নগর পরিকল্পনা:

• হরপ্পা ও মোহনজোদারো শহরগুলি অত্যন্ত সুপরিকল্পিত ছিল। শহরগুলো চতুষ্কোণ গ্রিড পদ্ধতিতে নির্মিত হয়েছিল, যেখানে সড়কগুলো পরস্পরের সাথে লম্বভাবে কাটা পড়ত।
• প্রতিটি শহরে দুর্গ এবং নিচের শহর নামে দুটি প্রধান অংশ ছিল। দুর্গে প্রশাসনিক ভবন ও ধর্মীয় স্থান ছিল, আর নিচের শহরে সাধারণ মানুষের বসবাস ছিল।

স্যানিটেশন ব্যবস্থা:

• সিন্ধু সভ্যতার শহরগুলো উন্নত ড্রেনেজ ব্যবস্থা দ্বারা সুসজ্জিত ছিল। প্রতিটি বাড়ি একটি ব্যক্তিগত স্নানাগার ও কূপের সাথে সংযুক্ত ছিল। নোংরা জল সরিয়ে নেওয়ার জন্য একটি কেন্দ্রীয় নর্দমা ব্যবস্থা ছিল।
• এই উন্নত স্যানিটেশন ব্যবস্থা প্রাচীন পৃথিবীতে বিরল ছিল।

বসতি ও বাড়িঘর:

• বাড়িগুলো ইট দিয়ে তৈরি হত এবং বেশিরভাগই এক বা দুই তলার ছিল। প্রতিটি বাড়িতে একটি খোলা উঠান, স্নানাগার, এবং রান্নার জায়গা ছিল।
• ইটগুলো সমান আকারের ছিল এবং এগুলি পোড়ানো ইট, যা সেই সময়ের জন্য অত্যন্ত উন্নত প্রযুক্তি নির্দেশ করে।

অর্থনীতি ও পেশা:

• সিন্ধু সভ্যতার মানুষ কৃষি, বাণিজ্য, এবং শিল্পে নিযুক্ত ছিল। প্রধান ফসল ছিল গম, যব, তুলা, এবং মসুর।
• তারা সুমের (মেসোপটেমিয়া) এবং পারস্যের সাথে বাণিজ্য করত। সিন্ধু সভ্যতার পণ্যগুলির মধ্যে সীলমোহর, পুঁথি, এবং মৃৎশিল্প উল্লেখযোগ্য।

ধর্মীয় জীবন:

• মানুষ প্রকৃতি পূজা করত এবং পশুদের পবিত্র মনে করত। "পশুপতি" বা শিবের আদি রূপ এবং মাতৃদেবীর মূর্তি পাওয়া গেছে।
• ধর্মীয় স্থানগুলির চেয়ে স্নানাগার, যেমন মোহনজোদারোর "বৃহৎ স্নানাগার," বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

শিল্প ও বিজ্ঞান:

• সিন্ধু সভ্যতা উন্নত মৃৎশিল্প, ধাতব কাজ, এবং মাপজোখের ব্যবস্থার জন্য পরিচিত ছিল।
• তারা সঠিক পরিমাপের জন্য মানসম্মত ওজন এবং মাপ ব্যবহার করত।

সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা:

• সমাজ শ্রেণিভিত্তিক হলেও সুষম ছিল। কোন রাজা বা বিশাল সামরিক শক্তির অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
• প্রশাসন গণতান্ত্রিক হতে পারে বলে ধারণা করা হয়।

সিন্ধু সভ্যতা উন্নত নগর ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, এবং সাংস্কৃতিক উৎকর্ষের জন্য ইতিহাসে স্মরণীয়। এটি শুধু প্রাচীন সভ্যতাগুলির মধ্যে নয়, বরং সমগ্র মানবজাতির ইতিহাসে একটি অনন্য উদাহরণ।

৪.হরপ্পা সভ্যতার অধিবাসীদের অর্থনৈতিক কার্যকলাপ আলোচনা করো।

উত্তর: ভূমিকা: হরপ্পা সভ্যতার অধিবাসীরা অত্যন্ত উন্নত ও সংগঠিত অর্থনৈতিক কার্যকলাপে নিযুক্ত ছিল। কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য, এবং পশুপালনের মতো বিভিন্ন কার্যকলাপ তাদের অর্থনীতির মূল ভিত্তি গঠন করেছিল। নিচে তাদের অর্থনৈতিক কার্যকলাপের প্রধান দিকগুলি আলোচনা করা হলো:

কৃষি:

• হরপ্পাবাসীরা কৃষি-ভিত্তিক অর্থনীতি পরিচালনা করত। গম, যব, সরষে, খেসারি ডাল এবং তুলার মতো ফসল উৎপন্ন করা হতো। তুলার চাষের জন্য হরপ্পা সভ্যতাকে প্রথম সভ্যতা হিসেবে ধরা হয়।
• সেচ ব্যবস্থার প্রমাণ পাওয়া যায়। নদীর পানিকে নিয়ন্ত্রণ করে চাষের জমিতে জল সরবরাহ করত।

পশুপালন:

• হরপ্পাবাসীরা গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, এবং শূকরের মতো গৃহপালিত পশু পালন করত।
• কৃষিকাজ এবং পরিবহন ব্যবস্থার জন্য বলদ এবং ঘোড়ার ব্যবহার ছিল।

শিল্প ও কারুশিল্প:

• হরপ্পা সভ্যতা তাদের দক্ষ কারুশিল্পের জন্য প্রসিদ্ধ। মৃৎশিল্প, সীলমোহর নির্মাণ, পুঁথি, ধাতব কাজ, এবং তুলার কাপড় তৈরি তাদের শিল্পকর্মের মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
• ধাতু, বিশেষ করে তামা, ব্রোঞ্জ, এবং সোনা ব্যবহার করে অলংকার ও হাতিয়ার তৈরি করা হতো।
• পুঁথি তৈরির জন্য কারিগররা বিভিন্ন মূল্যবান পাথর, যেমন লাজওয়ারি (ল্যাপিস লাজুলি), ব্যবহার করত।

বাণিজ্য:

• বাণিজ্য ছিল হরপ্পা সভ্যতার অর্থনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ। অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য ছাড়াও সুমের (মেসোপটেমিয়া) এবং পারস্যের সঙ্গে বাণিজ্য চালু ছিল।
• প্রধান রপ্তানি পণ্যগুলির মধ্যে ছিল তুলার কাপড়, সীলমোহর, পুঁথি, এবং মৃৎশিল্প।
• আমদানিকৃত পণ্যগুলির মধ্যে লাজওয়ারি, তামা, এবং অন্যান্য মূল্যবান পাথর উল্লেখযোগ্য।

পরিবহন ব্যবস্থা:

• বাণিজ্যের জন্য তারা গরুর গাড়ি এবং নৌকাকে প্রধান পরিবহন মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করত।
• সিন্ধু নদ এবং এর উপনদীগুলি জলপথ পরিবহন ও বাণিজ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত।

ওজন ও পরিমাপ:

• হরপ্পাবাসীরা একটি উন্নত ওজন ও পরিমাপ পদ্ধতি তৈরি করেছিল। বাণিজ্যের সুবিধার জন্য সুনির্দিষ্ট মাপের মানদণ্ড ছিল।

হরপ্পা সভ্যতার অর্থনৈতিক কার্যকলাপের বৈচিত্র্য এবং সংগঠিত পদ্ধতি প্রাচীন ভারতের অর্থনীতির ভিত্তি স্থাপন করেছিল। এটি তাদের সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পরিচয় বহন করে।

৫.ঋক্ বৈদিক সাহিত্যে আর্যদের সামাজিক যে চিত্র পাওয়া যায় তার বর্ণনা দাও।

উত্তর: ভূমিকা: ঋক্ বৈদিক সাহিত্যে আর্যদের সমাজজীবনের একটি বিশদ চিত্র পাওয়া যায়। এটি তাদের সামাজিক, ধর্মীয়, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবন সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রদান করে। আর্যদের সমাজ ছিল পিতৃতান্ত্রিক, যেখানে পরিবার এবং ধর্ম ছিল জীবনের কেন্দ্রবিন্দু।

পরিবার ও সমাজব্যবস্থা

• পরিবার ছিল সমাজের মৌলিক একক এবং এটি পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোর ওপর ভিত্তি করেই গঠিত ছিল। পরিবারের প্রধান ছিলেন গৃহপতি, যিনি পরিবারের সকল সদস্যের জন্য দায়িত্ব পালন করতেন।
• নারীদের সম্মানিত অবস্থান ছিল। তারা শিক্ষার অধিকার পেতেন এবং ধর্মীয় কাজেও অংশ নিতেন। উদাহরণস্বরূপ, অনেক নারী ঋষি যেমন গার্গী ও মৈত্রেয়ীর নাম ঋগ্বেদের সূত্রে পাওয়া যায়।
• যৌথ পরিবার ছিল প্রচলিত, যেখানে পরিবারের সকল সদস্য একসঙ্গে বসবাস করত।

গোত্র ও কুলব্যবস্থা

• আর্য সমাজে গোত্র ও কুলব্যবস্থা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত।
• গোত্রের নেতৃত্ব দিতেন গোত্রপতি, যিনি গোত্রের সুরক্ষা এবং একতা রক্ষার দায়িত্ব পালন করতেন।
• বিবাহ ছিল গোত্রের মধ্যে সম্পর্ক জোরদার করার একটি পদ্ধতি। আন্তঃগোত্র বিবাহের মাধ্যমে পারস্পরিক সৌহার্দ্য বৃদ্ধি পেত।

ধর্মীয় জীবন

• ঋগ্বৈদিক যুগে ধর্মীয় জীবনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল যজ্ঞ। এটি দেবতাদের তুষ্ট করার জন্য করা হতো।
• ইন্দ্র, অগ্নি, বরুণ, এবং সূর্য প্রধান দেবতা ছিলেন।
  • ইন্দ্র: যুদ্ধ ও বিজয়ের দেবতা।
  • অগ্নি: যজ্ঞের মধ্যস্থতাকারী।
  • বরুণ: নৈতিকতা ও ঋতুর রক্ষক।
  • সূর্য: আলোক ও শক্তির উৎস।
• ঋগ্বেদের স্তোত্রগুলিতে দেবতাদের উদ্দেশ্যে প্রশংসাগীতি এবং প্রার্থনার উল্লেখ আছে।
• সোমরস ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ পানীয়, যা যজ্ঞের সময় দেবতাদের অর্পণ করা হতো।

অর্থনৈতিক জীবন

• আর্যদের অর্থনীতি কৃষি, পশুপালন এবং বাণিজ্যের ওপর নির্ভরশীল ছিল।
• গরু ছিল ধনসম্পদের প্রতীক এবং বিনিময় মাধ্যম। “গোমাতা” শব্দটির মাধ্যমে গরুকে দেবত্ব প্রদান করা হয়েছিল।
• তারা ধান, গম, যব প্রভৃতি শস্য চাষ করত।
• পশুপালনের পাশাপাশি ক্ষুদ্র কারিগরি, যেমন ধাতু ও অস্ত্র তৈরির কাজ প্রচলিত ছিল।

বর্ণব্যবস্থা

• ঋগ্বৈদিক যুগে বর্ণব্যবস্থা খুবই নমনীয় ছিল।
• সমাজ চারটি মূল ভাগে বিভক্ত ছিল:
  • ব্রাহ্মণ: যাজক ও শিক্ষক।
  • ক্ষত্রিয়: যোদ্ধা ও শাসক।
  • বৈশ্য: কৃষক ও ব্যবসায়ী।
  • শূদ্র: শ্রমিক।
• তবে এই সময়ে বর্ণব্যবস্থা পেশার ওপর নির্ভরশীল ছিল, জন্মের ভিত্তিতে নয়।

শিক্ষা ও সংস্কৃতি

• শিক্ষা গুরু-শিষ্য পরম্পরার মাধ্যমে হতো। শিক্ষার্থীরা গুরুকুলে থেকে বেদ ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান শিখত।
• সংগীত, স্তোত্র, এবং কাব্য রচনায় আর্যরা দক্ষ ছিল।
• সংস্কৃত ভাষা ছিল সাহিত্য এবং ধর্মীয় পাঠের মাধ্যম।

সামাজিক বিনোদন

• আর্যরা বিনোদনের জন্য সংগীত, নৃত্য, এবং কাব্য রচনার চর্চা করত।
• যুদ্ধক্রীড়া, যেমন রথযুদ্ধ এবং শারীরিক দক্ষতা প্রদর্শনের প্রতিযোগিতা, তাদের বিনোদনের একটি অংশ ছিল।

নারীর অবস্থান

• নারীরা সম্মানিত ছিলেন এবং তাদের ধর্মীয় অধিকার ছিল। উদাহরণস্বরূপ, তারা যজ্ঞে অংশগ্রহণ করতে পারত এবং মন্ত্রপাঠ করতে পারত।
• যদিও নারীদের অবস্থান ধীরে ধীরে ক্ষয়প্রাপ্ত হতে শুরু করে, ঋগ্বৈদিক যুগে তারা অনেকটা স্বাধীন ছিলেন।

উপসংহার

ঋগ্বৈদিক সাহিত্য প্রাচীন আর্য সমাজের একটি সরল কিন্তু সংগঠিত চিত্র প্রদান করে। তাদের সমাজ জীবন ধর্ম, সংস্কৃতি এবং অর্থনীতির এক অভূতপূর্ব সমন্বয় ঘটিয়েছিল। সামাজিক কাঠামো এবং মূল্যবোধের ভিত্তিতে গঠিত এই সমাজ প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার ভিত্তি স্থাপন করেছিল।

৬.ঋক্-বৈদিক যুগে আর্যদের অর্থনৈতিক অবস্থার বিবরণ দাও। পরবর্তী বৈদিক যুগে এক্ষেত্রে যেসব পরিবর্তন লক্ষ করা যায় সেগুলি উল্লেখ করো।

উত্তর: ভূমিকা: ঋক্-বৈদিক যুগে আর্যদের অর্থনৈতিক অবস্থা প্রধানত কৃষি, পশুপালন এবং ক্ষুদ্র ব্যবসার ওপর নির্ভরশীল ছিল। অর্থনীতি ছিল সরল, এবং জীবনযাত্রার ভিত্তি ছিল প্রকৃতির সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। পরবর্তী বৈদিক যুগে অর্থনীতিতে বেশ কিছু পরিবর্তন ঘটে, যা সমাজের শ্রেণিবিন্যাস এবং উৎপাদন ব্যবস্থার প্রসারে সহায়তা করে।

ঋক্-বৈদিক যুগের অর্থনৈতিক অবস্থা

1. কৃষি:

   • কৃষি ছিল জীবিকার প্রধান উৎস।
   • তারা যব, গম, এবং ধান চাষ করত।
   • জলসেচ ব্যবস্থার খুব বেশি উন্নতি না হলেও বৃষ্টির ওপর কৃষি নির্ভর করত।
   • লাঙল চাষের প্রচলন ছিল, যদিও এটি প্রাথমিক পর্যায়ে ছিল।

2. পশুপালন:

   • গরু ছিল ধনসম্পদের প্রতীক এবং আর্থিক লেনদেনের মাধ্যম।
   • গরু, ঘোড়া, ছাগল, এবং ভেড়া পালন করা হতো।
   • "গোবিষ্টি" বা গরুর সংখ্যা ছিল সম্পদ নির্ধারণের মূল মাপকাঠি।

3. বাণিজ্য ও বিনিময়:

   • মুদ্রার প্রচলন না থাকায় বিনিময় পদ্ধতি (বার্টার সিস্টেম) প্রচলিত ছিল।
   • পণ্য, বিশেষত গরু, খাদ্যশস্য এবং হাতের তৈরি সামগ্রী বিনিময় করা হতো।

4. শিল্প ও কারিগরি:

   • কারিগরি ও হস্তশিল্প ছিল সীমিত। ধাতু থেকে অস্ত্র ও গৃহস্থালি সামগ্রী তৈরি করা হতো।
   • তাঁতশিল্প, মৃৎশিল্প, এবং চামড়াশিল্প কিছুটা উন্নত ছিল।

পরবর্তী বৈদিক যুগে অর্থনৈতিক পরিবর্তন

1. কৃষির প্রসার:

   • কৃষি উন্নত হয় এবং লৌহের ব্যবহার শুরু হয়, যা জমি চাষের ক্ষেত্রে বিপ্লব আনে।
   • ধান, গম ছাড়াও নতুন ফসল, যেমন তিল ও আখের চাষ শুরু হয়।

2. পশুপালনের গুরুত্ব হ্রাস:

   • কৃষি প্রধান জীবিকা হয়ে ওঠায় পশুপালনের গুরুত্ব কিছুটা কমে যায়।
   • তবে গরু এবং ঘোড়া এখনও সামাজিক ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

3. বাণিজ্য ও মুদ্রার ব্যবহার:

   • বিনিময় প্রথার পরিবর্তে ধাতব মুদ্রার ব্যবহার শুরু হয়।
   • বাণিজ্যের প্রসারে স্থলপথ এবং জলপথে পরিবহন ব্যবস্থার উন্নতি ঘটে।

4. শিল্প ও নগরায়ণ:

   • মৃৎশিল্প, লৌহশিল্প, এবং বস্ত্রশিল্পের বিকাশ ঘটে।
   • নগরায়ণের ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য এবং কারিগরি শিল্পে উন্নতি হয়।

5. সমাজে বর্ণভিত্তিক বিভাজন:

   • পেশার ভিত্তিতে সমাজের বর্ণ ব্যবস্থা শক্তিশালী হয়, যা অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপেও প্রভাব ফেলে।

উপসংহার

ঋক্-বৈদিক যুগে আর্যদের অর্থনীতি ছিল প্রকৃতিনির্ভর এবং সরল। পরবর্তী বৈদিক যুগে লৌহের ব্যবহার, নগরায়ণ, এবং বাণিজ্যের প্রসারের ফলে অর্থনীতিতে জটিলতা বৃদ্ধি পায়। এই পরিবর্তনগুলোই পরবর্তীকালে একটি সুসংহত অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে তুলতে সহায়ক হয়।

৭.কিভাবে বিবর্তনের মধ্য দিয়ে আদিম মানুষ শিকারী-খাদ্য সংগ্ৰহ থেকে স্থায়ী বসবাসকারীতে পরিণত হয়?

উত্তর: ভূমিকা: মানুষের বিবর্তনের ইতিহাসে শিকারী-খাদ্য সংগ্রহকারীর জীবন থেকে স্থায়ী বসবাসকারী হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। প্রাচীন মানবসমাজে পরিবেশ, প্রাকৃতিক সম্পদ, এবং প্রযুক্তিগত অগ্রগতির সাথে মানিয়ে নেওয়ার ফলে ধীরে ধীরে জীবনযাত্রায় স্থায়িত্ব আসে।

শিকারী-খাদ্য সংগ্রহকারীর জীবন

• প্রাথমিক পর্যায়ে আদিম মানুষ খাদ্যের জন্য সম্পূর্ণভাবে প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল ছিল। তারা শিকার করে, ফলমূল সংগ্রহ করে এবং পানির উৎসের কাছাকাছি বসবাস করত।
• শিকারী-জীবনযাপন মূলত যাযাবর ছিল, কারণ খাদ্য এবং পানির সহজলভ্যতা নির্ধারণ করত তাদের বসবাসের স্থান।
• গোষ্ঠীগত জীবনযাপনের মাধ্যমে তারা নিরাপত্তা এবং খাদ্য সংগ্রহে সহযোগিতা করত।

বিবর্তনের প্রক্রিয়া

1. আগুনের ব্যবহার:

   • আগুন আবিষ্কার তাদের জীবনযাত্রার একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনে। এটি খাদ্য রান্না করা এবং ঠান্ডা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ব্যবহৃত হয়।
   • আগুনের ব্যবহার তাদের গুহায় স্থায়ীভাবে বসবাসের পথ প্রশস্ত করে।

2. কৃষির আবিষ্কার:

   • প্রায় ১০,০০০ বছর আগে নব্যপ্রস্তর যুগে মানুষ কৃষির সন্ধান করে। তারা বীজ বপন ও শস্য উৎপাদনের কৌশল রপ্ত করে।
   • কৃষির ফলে খাদ্যের স্থায়ী যোগান নিশ্চিত হয় এবং মানুষ বসতি স্থাপন করতে শুরু করে।

3. পশুপালন:

   • গবাদি পশু পালন মানুষকে দুধ, মাংস, এবং শক্তি সরবরাহ করত। এটি শিকার নির্ভরতা কমিয়ে দেয়।
   • গরু, ছাগল, ভেড়ার মতো প্রাণী গৃহপালিত হয়।

4. স্থায়ী বসতির গঠন:

   • শস্য উৎপাদন এবং পশুপালনের ফলে মানুষ স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন শুরু করে।
   • গ্রাম গড়ে ওঠে এবং সমাজব্যবস্থা ধীরে ধীরে সংগঠিত হয়।

5. পাথরের সরঞ্জামের উন্নয়ন:

   • কৃষি ও শিকার উভয়ের জন্য উন্নত সরঞ্জাম তৈরি করা হয়।
   • লাঙল, কাস্তে, এবং অন্যান্য যন্ত্রপাতি কৃষিকাজকে সহজ করে।

6. বিনিময় ও যোগাযোগ:

   • শস্যের উদ্বৃত্ত উৎপাদন বিনিময়ের পদ্ধতি চালু করে এবং বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে যোগাযোগ বাড়ায়।

উপসংহার

বিবর্তনের এই প্রক্রিয়া মানুষকে প্রকৃতি থেকে সম্পূর্ণভাবে স্বাধীন না করলেও তাকে একটি সুসংগঠিত জীবনধারা উপহার দিয়েছে। কৃষি ও পশুপালনের উন্নতির ফলে শিকারী-খাদ্য সংগ্রহকারী থেকে মানুষ স্থায়ী বসবাসকারী এবং পরবর্তী কালে নগরায়ণের পথে এগিয়ে যায়। এটি মানবসভ্যতার প্রথম গুরুত্বপূর্ণ ধাপ বলে বিবেচিত হয়।

৮.বৌদ্ধ ধর্মের মূল বৈশিষ্ট্য আলোচনা করো।

উত্তর: ভূমিকা: বৌদ্ধ ধর্ম ভারতীয় উপমহাদেশে গৌতম বুদ্ধের দর্শনের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্ম। এটি একাদশ শতাব্দীতে জন্ম নেয় এবং দুঃখের কারণ ও তার মোক্ষ লাভের পথ নির্দেশ করে। বৌদ্ধ ধর্ম সহজ, নীতিনিষ্ঠ এবং আচারবিচারহীন জীবনযাপনের ওপর জোর দেয়।

বৌদ্ধ ধর্মের মূল বৈশিষ্ট্য

১. চতুরার্য সত্য (Four Noble Truths)

বৌদ্ধ ধর্মের কেন্দ্রীয় দর্শন হল চতুরার্য সত্য, যা জীবনের দুঃখ এবং তার সমাধান সম্পর্কে নির্দেশ করে।

• দুঃখ: জীবন মূলত দুঃখময়।
• দুঃখসমুদয়: কামনা-বাসনা বা তৃষ্ণাই দুঃখের মূল কারণ।
• দুঃখনিরোধ: কামনা ত্যাগের মাধ্যমে দুঃখের নিরোধ সম্ভব।
• দুঃখনিরোধগামী পথ: অষ্টাঙ্গিক মার্গ অনুসরণ করে মোক্ষ লাভ করা যায়।

২. অষ্টাঙ্গিক মার্গ (Eightfold Path)

মোক্ষ লাভের জন্য গৌতম বুদ্ধ আটটি নীতির কথা বলেছেন:

• সম্যক দৃষ্টি: সঠিক ধারণা।
• সম্যক সংকল্প: সঠিক মনোভাব।
• সম্যক বাক: সৎ কথা বলা।
• সম্যক কর্ম: সৎ কাজ করা।
• সম্যক আজীবিকা: সৎ উপায়ে জীবিকা নির্বাহ।
• সম্যক ব্যায়াম: নিজের চিন্তা ও কাজ শুদ্ধ করা।
• সম্যক স্মৃতি: নিজের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে সচেতন থাকা।
• সম্যক সমাধি: আত্মিক একাগ্রতা অর্জন।

৩. অনিত্য (Impermanence)

বৌদ্ধ ধর্মে বলা হয়েছে যে, সব কিছুই অস্থায়ী এবং পরিবর্তনশীল। এ কারণে জীবন এবং এর ভোগ্য জিনিসে আসক্ত না হয়ে মোক্ষের পথ অনুসরণ করতে হবে।

৪. অনাত্মবাদ (No-Self)

এই ধর্মের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল অনাত্মবাদ। এটি বলে যে, কোনও নির্দিষ্ট আত্মা বা স্থায়ী সত্তা নেই; বরং জীবন পরিবর্তনশীল উপাদানের সমষ্টি।

৫. পঞ্চশীল (Five Precepts)

ধর্মীয় আচরণ হিসেবে বৌদ্ধ ধর্ম পঞ্চশীল মেনে চলার নির্দেশ দেয়:

• হত্যা না করা।
• চুরি না করা।
• মিথ্যা না বলা।
• অসতর্ক জীবনযাপন এড়ানো।
• মাদকাসক্তি এড়ানো।

৬. করুণার নীতি

বৌদ্ধ ধর্ম মানবজাতির প্রতি করুণা, সহমর্মিতা এবং সহিষ্ণুতা প্রদর্শনের ওপর গুরুত্ব দেয়।

৭. নির্বাণ (Nirvana)

নির্বাণ হল দুঃখ থেকে মুক্তি এবং চিরন্তন শান্তি অর্জন। এটি কামনা, ক্রোধ এবং অজ্ঞানের অবসানের মাধ্যমে সম্ভব।

উপসংহার

বৌদ্ধ ধর্ম তার সহজ নীতি এবং অহিংস জীবনযাত্রার মাধ্যমে মানবসভ্যতায় এক গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করেছে। এর মৌলিক নীতিগুলি জীবন ও প্রকৃতির গভীর সত্যকে উপলব্ধি করার জন্য পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করে।

৯.জৈন ধর্মের প্রচারে মহাবীরের ভূমিকা আলোচনা করো।

উত্তর: ভূমিকা: জৈন ধর্মের প্রচারে মহাবীরের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মহাবীর, যিনি বর্ধমান মহাবীর বা বীর মহাবীর নামে পরিচিত, জৈন ধর্মের ২৪তম এবং শেষ তীর্থঙ্কর ছিলেন। তিনি খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে জন্মগ্রহণ করেন এবং জৈন ধর্মকে একটি সুশৃঙ্খল দর্শন ও জীবনপদ্ধতিতে পরিণত করেন। তাঁর প্রচার কার্যকলাপ জৈন ধর্মকে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে দিতে সহায়ক হয়।

মহাবীরের ভূমিকা

১. জৈন ধর্মের সংস্কার

• মহাবীর জৈন ধর্মে বেশ কিছু সংস্কার আনেন। পূর্ববর্তী তীর্থঙ্করগণ যে নীতিগুলি প্রচার করেছিলেন, মহাবীর সেগুলিকে নতুন আঙ্গিকে উপস্থাপন করেন।
• তিনি জৈন ধর্মকে সাধারণ মানুষের কাছে আরও গ্রহণযোগ্য করে তোলেন।

২. অহিংসার প্রচার

• মহাবীর অহিংসার নীতিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, "সব প্রাণীর প্রতি সহানুভূতি এবং মমত্ববোধ থাকা উচিত।"
• তিনি শুধু শারীরিক নয়, মানসিক এবং বাক-আচরণেও অহিংসার ওপর জোর দিয়েছিলেন।
  

৩. পঞ্চ মহাব্রত প্রচলন

মহাবীর পাঁচটি ব্রতের কথা বলেন, যা জৈন ধর্মের মৌলিক নীতি হিসেবে পরিচিত:

• অহিংসা (হিংসা না করা)।
• সত্য (সত্য কথা বলা)।
• অচৌর্য (চুরি না করা)।
• ব্রহ্মচর্য (সংযম পালন করা)।
• অপরিগ্রহ (সম্পদের প্রতি আসক্তি ত্যাগ করা)।

৪. ত্যাগ ও কঠোর সাধনা

• মহাবীর নিজে কঠোর তপস্যা ও ত্যাগের মাধ্যমে মানুষের সামনে উদাহরণ স্থাপন করেন।
• তিনি ১২ বছর কঠোর তপস্যা করে কেবল্য জ্ঞান (সর্বোচ্চ জ্ঞান) লাভ করেন। এর ফলে তাঁর জীবনাদর্শ মানুষের মধ্যে গভীর প্রভাব ফেলে।

৫. সাধারণ ভাষায় ধর্ম প্রচার

• মহাবীর সাধারণ মানুষের বোঝার সুবিধার্থে প্রাকৃত ভাষায় (অভিজাত সংস্কৃত নয়) তাঁর ধর্মোপদেশ দেন।
• এর ফলে সমাজের নীচু স্তরের মানুষও তাঁর আদর্শকে সহজে গ্রহণ করতে পারে।

৬. সংগঠনের প্রতিষ্ঠা

• মহাবীর সন্ন্যাসী এবং গৃহীদের মধ্যে একটি সুশৃঙ্খল ধর্মীয় সংগঠন গড়ে তোলেন।
• তিনি জৈন ধর্মকে দুটি শাখায় ভাগ করেন: শ্বেতাম্বর (যাঁরা সাদা বস্ত্র পরেন) এবং দিগম্বর (যাঁরা নগ্ন থাকেন)।

৭. প্রচারের বিস্তার

• মহাবীর তাঁর জীবদ্দশায় মগধ, কোশল, বিদেহ, এবং কাশি-সহ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে ঘুরে ধর্ম প্রচার করেন।
• রাজা বিম্বিসার এবং অজাতশত্রুর মতো রাজন্যবর্গও তাঁর ধর্মে আকৃষ্ট হন।

উপসংহার

মহাবীরের জীবনাদর্শ ও প্রচার কার্যকলাপ জৈন ধর্মকে একটি সুসংগঠিত ধর্মীয় দর্শনে পরিণত করে। তাঁর অহিংসা, সত্য, এবং ত্যাগের শিক্ষা কেবল জৈন সম্প্রদায় নয়, সমগ্র মানবজাতির জন্য অনুপ্রেরণার উৎস। মহাবীরের প্রচেষ্টার ফলেই জৈন ধর্ম ভারত এবং বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে সমাদৃত।

১০.হরপ্পা সভ্যতার নগর পরিকল্পনা আলোচনা করো।

উত্তর: ভূমিকা: হরপ্পা সভ্যতা, যা সিন্ধু সভ্যতা নামেও পরিচিত, প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ ছিল। এটি বর্তমান পাকিস্তান এবং উত্তর-পশ্চিম ভারত অঞ্চলে বিস্তৃত ছিল এবং প্রায় ২৬০০ থেকে ১৯০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে floreিত ছিল। হরপ্পা সভ্যতার নগর পরিকল্পনা তার সমৃদ্ধ এবং উন্নত জীবনযাত্রার প্রতীক। এই সভ্যতা শহর নির্মাণের ক্ষেত্রে অত্যন্ত সুসংগঠিত ছিল এবং এর নগর পরিকল্পনা এক অভিনব বৈশিষ্ট্য ছিল।

নগর পরিকল্পনার প্রধান বৈশিষ্ট্য

১. সড়ক ও গলি ব্যবস্থা

হরপ্পা সভ্যতার শহরগুলির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ছিল তার সড়ক এবং গলি ব্যবস্থা।

• নগরের প্রধান সড়কগুলি ছিল প্রশস্ত এবং সোজা।
• সড়কগুলো একে অপরকে ৯০ ডিগ্রি কোণে সংযুক্ত ছিল, ফলে শহরে চলাচল সহজ ছিল।
• রাস্তার পাশে মাটির সীমানা তৈরি করা ছিল, যা পানি চলাচল নিয়ন্ত্রণে সহায়ক ছিল।
• শহরের অভ্যন্তরে ছোট ছোট গলির মাধ্যমে মানুষের চলাফেরা ছিল, তবে এগুলি কখনও কখনও সরু ছিল।

২. পানির ব্যবস্থা

হরপ্পা সভ্যতায় পানি সরবরাহ এবং নিষ্কাশন ব্যবস্থায় উন্নতি ছিল।

• শহরগুলোতে ঘর-বাড়ির কাছে পুকুর ও কুয়ো ছিল যা পানির সরবরাহ নিশ্চিত করত।
• স্নানঘর ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা অত্যন্ত উন্নত ছিল। শহরগুলিতে পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থাও ছিল, এবং রাস্তার নিচে পদ্ধতিগতভাবে পয়ঃবাহন ব্যবস্থা স্থাপন করা হয়েছিল, যা পরবর্তী সভ্যতায় এক অনন্য উদাহরণ।

৩. ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা

• হরপ্পা সভ্যতার শহরগুলোতে বাড়িঘরগুলো পাথর, ইট এবং কাঠের তৈরি ছিল।
• বাড়িগুলি ছিল এক বা দুই তলবিশিষ্ট, এবং প্রত্যেক বাড়ির মধ্যে একটি আঙ্গিনা ছিল।
• কিছু বাড়িতে বিশেষভাবে পরিকল্পিত রান্নাঘর ও স্নানাগার ছিল।
• শহরগুলোর কিছু অংশে বড় বড় ভবন ছিল, যা প্রশাসনিক অথবা ধর্মীয় কাজে ব্যবহৃত হতো।

৪. নগর পরিকল্পনার সিমেট্রিকাল বৈশিষ্ট্য

• হরপ্পা শহরগুলির নির্মাণে এক নিখুঁত সিমেট্রিকাল ডিজাইন ছিল।
• শহরের কেন্দ্রস্থলে একটি বড় এবং প্রশস্ত এলাকায় পানির ব্যবস্থা ও স্নানাগার ছিল।
• নগরের বেশিরভাগ অংশে ইটের নির্মাণ কাজ ছিল, যা শহরের পরিকল্পনা ও তার স্থায়িত্বের প্রমাণ।

৫. বাণিজ্য ও শিল্পকলা কেন্দ্র

• হরপ্পা সভ্যতার শহরগুলিতে শিল্পকলা, বাণিজ্য এবং ব্যবসায়িক কার্যক্রম চলত।
• নানান ধরনের নির্মাণ সামগ্রী, ধাতু, মণি, পাথরের তৈরি সামগ্রী ইত্যাদি শহরে ব্যবসা এবং বাণিজ্যের সঙ্গেই যুক্ত ছিল।
• হরপ্পা শহরগুলো সমুদ্রপথে বাণিজ্য করত এবং মেসোপটেমিয়া সহ অন্যান্য অঞ্চলের সাথে তাদের সম্পর্ক ছিল।

উপসংহার

হরপ্পা সভ্যতার নগর পরিকল্পনা অত্যন্ত সুশৃঙ্খল এবং চিন্তাশীল ছিল। আধুনিক নগর পরিকল্পনার অনেক দিক এই সভ্যতার আদল অনুসরণ করেছিল। সড়ক, জল ব্যবস্থা, স্যানিটেশন এবং ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে তার উদ্ভাবনী ধারণা আজও অনেক দিক থেকে প্রশংসিত। হরপ্পা সভ্যতার এই নগর পরিকল্পনার বৈশিষ্ট্য তার উন্নত প্রযুক্তি এবং সভ্যতার সমৃদ্ধির চিত্র উপস্থাপন করে।