🌹বি.এ সেমিষ্টার-৪::মেজর ইতিহাস(পেপার-২)+মাইনর ইতিহাস সাজেশন(PART-3)🌹

 

 

✍️প্রশ্নের মান-১০: 

📝 ১. দিল্লির সুলতানিকে সুদৃঢ় করার জন্য ইলতুৎমিস কর্তৃক গৃহীত ব্যবস্থাগুলি বিশ্লেষণ করো।

অথবা, ইলতুৎমিসকে কেন দিল্লি সুলতানের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়, তা আলোচনা করো।

---

✅ উত্তরঃ

ভূমিকা: ইলতুৎমিস (রাজত্বকাল: ১২১১–১২৩৬ খ্রি.) ছিলেন গুলাম বংশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শাসক এবং দক্ষ রাষ্ট্রনায়ক। তিনি কুতুবউদ্দিন আইবকের জামাতা ও সেনাপতি ছিলেন। কুতুবউদ্দিন আইবক দিল্লি সুলতানির ভিত্তি স্থাপন করলেও, প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তুলতে ব্যর্থ হন। অন্যদিকে, ইলতুৎমিস বিভিন্ন বিদ্রোহ দমন, প্রশাসনিক পুনর্গঠন, অর্থনৈতিক সংস্কার, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি প্রভৃতি উদ্যোগের মাধ্যমে দিল্লি সুলতানিকে সুদৃঢ় করে তুলেছিলেন।

🔷 ইলতুৎমিসের গৃহীত গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থা:

✅ ১. রাজনৈতিক স্থিতি প্রতিষ্ঠা:

• তিনি রাজত্বের শুরুতেই লাহোর, বদায়ুঁ, বেঙ্গল প্রভৃতি অঞ্চলের বিদ্রোহ দমন করেন।

• ভাসাল রাজাদের দমন করে কেন্দ্রীয় কর্তৃত্ব স্থাপন করেন।

✅ ২. রাজনৈতিক রাজধানী নির্ধারণ:

• তিনি লাহোরের পরিবর্তে দিল্লিকে রাজধানী করেন, যা প্রশাসনিক ও সামরিক দিক থেকে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

✅ ৩. চলিশা (Shura-e-Khalisa) গঠন:

• বিশিষ্ট তুর্কি অভিজাতদের নিয়ে একটি পরামর্শক পরিষদ গঠন করেন, যা তাকে রাজ্য পরিচালনায় সাহায্য করত।

✅ ৪. আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ:

• তিনি আব্বাসীয় খলিফার কাছ থেকে স্বীকৃতি আদায় করেন, যা দিল্লি সুলতানির ধর্মীয় ও আন্তর্জাতিক মর্যাদা বৃদ্ধি করে।

✅ ৫. মুদ্রানীতি ও অর্থনৈতিক সংস্কার:

• রূপার মুদ্রা "টঙ্কা" এবং তামার মুদ্রা "জিতাল" চালু করেন।

• এর ফলে রাজস্ব ব্যবস্থা শক্তিশালী হয় এবং বাণিজ্য বৃদ্ধি পায়।

✅ ৬. বঙ্গ বিজয়:

• লখনৌতি (বঙ্গ) শাসকের বিদ্রোহ দমন করে তা দিল্লির নিয়ন্ত্রণে আনেন।

✅ ৭. উত্তরাধিকারের প্রশ্নে উদারতা:

• তিনি তার কন্যা রজিয়া সুলতানাকে উত্তরাধিকারী নিযুক্ত করেন, যা মধ্যযুগের পিতৃতান্ত্রিক সমাজে বিরল পদক্ষেপ।

🔷 ইলতুৎমিসকে 'প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা' বলা হয় কেন?

• কুতুবউদ্দিন আইবক মাত্র চার বছর রাজত্ব করেন এবং কোন স্থায়ী প্রশাসনিক কাঠামো গঠন করতে পারেননি।

• ইলতুৎমিস সুলতানিকে রাজনৈতিকভাবে একত্রিত করেন, প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তোলেন, মুদ্রানীতি প্রবর্তন করেন, এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায় করেন।

• এইসব কর্মকাণ্ডের ভিত্তিতেই ইতিহাসবিদরা তাকে "দিল্লি সুলতানির প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা" বলে আখ্যায়িত করেন।

📝 উপসংহারঃ

ইলতুৎমিসের শাসনকাল ছিল দিল্লি সুলতানির জন্য এক সুদৃঢ় ভিত্তি রচনার সময়কাল। রাজনৈতিক স্থিতি, প্রশাসনিক দক্ষতা, অর্থনৈতিক সংস্কার ও ধর্মীয় বৈধতার মাধ্যমে তিনি সুলতানিকে সুসংবদ্ধ রূপ দেন।

এইসব কারণে তাঁকেই দিল্লি সুলতানির প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়।

📝 ২. দিল্লি সুলতানি সাম্রাজ্যের সংহতি সাধনের জন্য গিয়াস উদ্দিন বলবনের অবদান কী ছিল তা আলোচনা করো।

অথবা, বলবন কীভাবে তার শাসনকালে দিল্লি সুলতানিকে সুদৃঢ় করেছিলেন তা আলোচনা করো।

✅ উত্তরঃ

🔷ভূমিকা: গিয়াস উদ্দিন বলবন (শাসনকাল: ১২৬৬ – ১২৮৭ খ্রি.) ছিলেন দিল্লির গুলাম বংশের সর্বশেষ শক্তিশালী সুলতান। তিনি তার দীর্ঘ কর্মজীবনে প্রথমে নাসিরউদ্দিন মাহমুদের প্রধান মন্ত্রী এবং পরে দিল্লির সুলতান হিসেবে ভারতবর্ষে রাজনৈতিক সংহতি ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য একাধিক কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তার শাসনকালে দিল্লি সুলতানি এক নতুন শক্তির রূপ পায়।

🔷 বলবনের শাসনকালের প্রধান অবদানসমূহঃ

 ✅ ১. কেন্দ্রীয় শাসনকে মজবুতকরণ:

• বলবন মনে করতেন সুলতানকে ‘জিল-ই-ইলাই’ অর্থাৎ “ঈশ্বরের ছায়া” হিসেবে দেখা উচিত। এর ফলে রাজশক্তির প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা বেড়ে যায়।

• তিনি সুলতানের মর্যাদা ও গাম্ভীর্য রক্ষার জন্য দরবারে কঠোর নিয়ম চালু করেন (যেমন— সিজদাহ এবং পায়েবোস প্রথা)।

✅ ২. চলিশা বা তুর্কি অভিজাতদের দমন:

• বলবনের পূর্বসূরি ইলতুৎমিস ‘চলিশা’ নামে অভিজাতদের একটি পরিষদ গঠন করেছিলেন, যারা সুলতানের ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করত।

• বলবন সিংহাসনে বসেই এই ‘চলিশা’ পরিষদ ধ্বংস করেন এবং রাজশক্তিকে সর্বোচ্চ করে তোলেন।

✅ ৩. সামন্ত বিদ্রোহ দমন:

• রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলের আমির ও অভিজাতরা স্বায়ত্তশাসনের চেষ্টা করত। বলবন শক্ত হাতে এসব বিদ্রোহ দমন করেন।

• তবাবিন, বুখারী প্রভৃতি বিদ্রোহীদের কঠোরভাবে দমন করে তিনি কেন্দ্রীয় শাসনের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন।

✅ ৪. দণ্ডনীতি ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা:

• বলবনের নীতি ছিল— "সুলতান হওয়া মানেই ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা"।

• অপরাধ দমনে তিনি কঠোর শাস্তি প্রয়োগ করতেন এবং রাজ্যজুড়ে আইন ও শৃঙ্খলার কঠোর রক্ষা করেন।

• তার মতে, রাজ্য পরিচালনার মূল ভিত্তি “নিয়ম ও শাস্তি”।

✅ ৫. দুর্বলদের বিরুদ্ধে কঠোরতা:

• বলবন দুর্বল শাসকদের প্রতি ঘৃণা করতেন। তিনি বলতেন, "দুর্বলতা হল রাজনীতির পাপ।"

• তিনি নিজে অত্যন্ত দৃঢ়প্রতিজ্ঞ শাসক ছিলেন এবং কাউকে ছাড় দিতেন না।

✅ ৬. রক্ষণাত্মক রাজনীতি ও সীমান্ত রক্ষা:

• উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে মঙ্গোলদের আক্রমণ প্রতিরোধে তিনি সীমান্তে “দৌলতাবাদ” নামে দুর্গ নির্মাণ করেন এবং প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মজবুত করেন।

• তিনি মুলতান ও লাহোর অঞ্চলে শক্তিশালী সেনা মোতায়েন করেন।

✅ ৭. নাগরিক প্রশাসন ও গুপ্তচর ব্যবস্থার সংস্কার:

• বলবন রাজ্যজুড়ে গুপ্তচর বাহিনী গঠন করেন যারা প্রতিটি অঞ্চলের খবর সুলতানকে দিত।

• দুর্নীতিগ্রস্ত ও অকর্মণ্য কর্মচারীদের কঠোর শাস্তি দিতেন।

✅ ৮. পলিটিক্যাল আইডিওলজি – “নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্র”:

• বলবন বলেন, “রাজা যদি দুর্বল হয়, তবে জনগণ দণ্ডহীনভাবে অবাধ্য হয়ে পড়ে।” এজন্য তিনি ‘নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্র’ বা Absolute Monarchy কায়েম করেন।

✅ ৯. তাত্ত্বিক ভিত্তি – পারস্য প্রভাব:

• বলবনের শাসনব্যবস্থায় পারস্য সংস্কৃতির ব্যাপক প্রভাব ছিল। তার দরবারে পারস্যের প্রথা, পোশাক ও আচরণ অনুসৃত হতো।

🔷 উপসংহারঃ

গিয়াস উদ্দিন বলবন ছিলেন দিল্লি সুলতানির এক কঠোর, বাস্তববাদী এবং দূরদর্শী শাসক। তিনি রাষ্ট্রকে কেন্দ্রভিত্তিক, নিয়মতান্ত্রিক এবং আইনের শাসনে পরিচালিত করতেন। চলিশা ধ্বংস, রাজশক্তি সুসংহতকরণ, শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা, মঙ্গোল আক্রমণ প্রতিরোধ, ও সামন্ত দমন— সব মিলিয়ে তিনি দিল্লি সুলতানির ভিতকে এতটাই মজবুত করেন যে তার পরবর্তী শাসকেরা বহুদিন এ ভিতের উপর দাঁড়িয়ে শাসন করতে পেরেছেন।

এইসব কারণেই বলবনকে দিল্লি সুলতানির দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠাতা হিসেবেও আখ্যা দেওয়া হয়ে থাকে।

📝 ৩. খলজি বিপ্লব কী? এই বিপ্লবের গুরুত্ব বা তাৎপর্য আলোচনা করো।

✅ উত্তর:

🔶 ভূমিকা: দিল্লি সুলতানি ইতিহাসে ‘খলজি বিপ্লব’ একটি গুরুত্বপূর্ণ যুগান্তকারী ঘটনা। তুর্কি আমলের পর খলজি বংশের উত্থানকে শুধুমাত্র একটি বংশ পরিবর্তন না বলে, বরং তা রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও সামাজিক পরিবর্তনের এক যুগ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। সুলতান জালালউদ্দিন খলজি দিল্লির সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়ে নতুন ধারা সূচনা করেন।

🔶 খলজি বিপ্লব কী?

খলজি বিপ্লব বলতে বুঝায়, তুর্কি বংশীয় শাসকদের একচেটিয়া আধিপত্যের অবসান ঘটিয়ে অ-তুর্কি খলজি বংশের শাসন প্রতিষ্ঠা। খলজিরা মূলত আফগানিস্থান থেকে আগত ছিল, কিন্তু তুর্কিদের কাছে তারা নিচু জাত হিসেবে গণ্য হতো। ১২৯০ খ্রিস্টাব্দে খলজি বিপ্লবের মাধ্যমে জালালউদ্দিন খলজি ক্ষমতা গ্রহণ করেন এবং বহুদিনের তুর্কি আধিপত্যের অবসান ঘটান।

🔶 বিপ্লবের কারণ:

• তুর্কি অভিজাতদের মধ্যে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব বৃদ্ধি।

• আরামপ্রিয় লঘু প্রশাসনের বিরুদ্ধে অস্বস্তি।

• সেনাবাহিনীতে অ-তুর্কি ও ভারতীয় মুসলিমদের সংখ্যা বৃদ্ধি।

• ক্ষমতালোভী খলজি গোষ্ঠীর কূটনীতি ও সামরিক কৌশল।

🔶 বিপ্লবের তাৎপর্য ও গুরুত্ব:

✅ ১. তুর্কি অভিজাতদের পতন:
তুর্কি অভিজাত ও দাস বংশীয় শাসকদের একচেটিয়া ক্ষমতা বিলুপ্ত হয়। এর ফলে প্রশাসন আরও গণমুখী ও আধুনিক হতে থাকে।

✅ ২. নতুন অভিজাত শ্রেণির উত্থান:
খলজি বংশ ভারতের স্থানীয় মুসলমান ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের লোকদের প্রশাসনে অন্তর্ভুক্ত করেন, ফলে এক নতুন শাসকগোষ্ঠী গড়ে ওঠে।

✅ ৩. ভারতীয় উপমহাদেশের অধিকতর একীকরণ:
আলাউদ্দিন খলজির সময়ে দক্ষিণ ভারত পর্যন্ত মুসলিম শাসন সম্প্রসারিত হয়, যা দিল্লি সুলতানির বিস্তারের দিক থেকে বিপ্লবাত্মক।

✅ ৪. শাসন পদ্ধতিতে পরিবর্তন:
আলাউদ্দিন প্রশাসনে নতুন নীতির প্রবর্তন করেন — যেমন:

• মূল্যের নিয়ন্ত্রণ

• বাজার নিয়ন্ত্রণ

• কৃষি সংস্কার

• সেনা প্রশাসনের আধুনিকীকরণ

✅ ৫. হিন্দু রাজ্যগুলোর উপর নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি:
দাক্ষিণাত্যের হোয়সল, কাকতীয় ও পাণ্ড্য রাজ্য জয় করে দিল্লি সুলতানির প্রতিপত্তি জোরদার করেন।

🔶 উপসংহার:

খলজি বিপ্লব দিল্লি সুলতানির ইতিহাসে এক নতুন দিগন্তের সূচনা করে। এই বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু পরিবর্তিত হয়, সমাজে অধিক বৈচিত্র্য আসে এবং প্রশাসনিক পরিকাঠামোতে রূপান্তর ঘটে। ফলে বলা যায়, খলজি বিপ্লব ছিল কেবলমাত্র বংশ পরিবর্তন নয়, বরং একটি সমাজ-রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক বিপ্লব।

📝 ৪. আলাউদ্দিন খলজির দাক্ষিণাত্য নীতি আলোচনা করো।

✅ উত্তর:

🔶 ভূমিকা: আলাউদ্দিন খলজি ছিলেন খলজি বংশের শ্রেষ্ঠ ও প্রভাবশালী সুলতান। ১২৯৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৩১৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত শাসনকালীন সময়ে তিনি শুধু উত্তর ভারতে নয়, দক্ষিণ ভারতেও মুসলিম আধিপত্য বিস্তারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তাঁর দাক্ষিণাত্য অভিযান ছিল ঐতিহাসিক দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

🔶 দাক্ষিণাত্য নীতির পটভূমি:

• দক্ষিণ ভারতে তখন হোয়সল, কাকতীয়, এবং পাণ্ড্য রাজ্য ছিল স্বশাসিত ও ধনবান।

• আলাউদ্দিনের লক্ষ্য ছিল তাদের ধন-সম্পদ দখল করে দিল্লি সুলতানিকে আরও সমৃদ্ধ করা।

• সামরিক শক্তি বৃদ্ধির প্রয়োজন ছিল অর্থনৈতিক কারণে।

🔶 দাক্ষিণাত্য অভিযানের বিবরণ:

✅ ১. মালিক কাফুরের নেতৃত্বে অভিযান (১৩০৭-১৩১১ খ্রি.):
আলাউদ্দিনের সেনাপতি মালিক কাফুর দক্ষিণে একের পর এক অভিযান পরিচালনা করেন।

✅ ২. হোয়সল (দ্বারসমুদ্র):
হোয়সল রাজা ভির বল্লাল পরাজিত হন এবং বার্ষিক কর দিতে বাধ্য হন।

✅ ৩. কাকতীয় (ওয়ারাঙ্গল):
রাজা প্রতাপরুদ্র মালিক কাফুরের কাছে আত্মসমর্পণ করে উপঢৌকন ও কর প্রদান করেন।

✅ ৪. পাণ্ড্য (মাদুরাই):
এখানকার গৃহযুদ্ধের সুযোগ নিয়ে মালিক কাফুর বিশাল ধনসম্পদ দখল করে নিয়ে আসেন।

🔶 দাক্ষিণাত্য নীতির তাৎপর্য:

✅ ১. দক্ষিণ ভারত প্রথমবারের মতো দিল্লির কর্তৃত্বে আসে।

✅ ২. দিল্লি সুলতানি বিপুল ধন-সম্পদ অর্জন করে।

✅ ৩. দক্ষিণের রাজারাও দিল্লির করদ রাজা হয়ে ওঠেন।

✅ ৪. মুসলিম সাম্রাজ্যের প্রভাব সর্বভারতীয় রূপ পায়।

✅ ৫. দিল্লি সুলতানি একচেটিয়া উত্তর ভারতীয় রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসে।

🔶 উপসংহার:

আলাউদ্দিন খলজির দাক্ষিণাত্য অভিযান সাময়িক হলেও দীর্ঘমেয়াদী রাজনৈতিক, সামরিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব ফেলেছিল। তিনি শুধু উত্তর ভারতেই নয়, দক্ষিণ ভারতের গভীর প্রদেশ পর্যন্ত মুসলিম শাসনের ছাপ রেখে যান। এই নীতির মাধ্যমে দিল্লি সুলতানি একটি সাম্রাজ্যিক চরিত্র লাভ করে।

📝৫. আলাউদ্দিন খলজি কেন এবং কিভাবে মূল্য নিয়ন্ত্রণ নীতি প্রবর্তন করেন তা আলোচনা করো

✅ উত্তর:

🔶 ভূমিকা:

আলাউদ্দিন খলজি (শাসনকাল: ১২৯৬–১৩১৬ খ্রি.) ছিলেন দিল্লি সুলতানির অন্যতম শক্তিশালী ও কার্যকর শাসক। তিনি বিশ্বাস করতেন, একটি সুশৃঙ্খল সাম্রাজ্য গঠনের জন্য শুধু সেনাবাহিনী নয়, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাও নিয়ন্ত্রিত হওয়া প্রয়োজন। সেই লক্ষ্যেই তিনি মূল্য নিয়ন্ত্রণ নীতি (Price Control Policy) প্রবর্তন করেন—যা ছিল মধ্যযুগীয় ভারতের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ।

🎯 মূল্য নিয়ন্ত্রণ নীতি গ্রহণের কারণ:

🔹 ১. সেনাবাহিনীর খরচ কমানো:
তিনি একটি বিশাল সেনাবাহিনী গঠন করেন, যাদের নিয়মিত বেতন দেওয়া হতো। বাজারে দ্রব্যের দাম কম থাকলে বেতনের খরচ কম পড়ে।

🔹 ২. যুদ্ধের ব্যয় নিয়ন্ত্রণ:
মঙ্গোল আক্রমণ ও দক্ষিণ ভারতে অভিযান চালাতে রাজকোষে প্রচুর ব্যয় হতো। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রেখে এই ব্যয় সীমিত রাখা সম্ভব।

🔹 ৩. দুর্নীতি রোধ ও অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা বজায় রাখা:
চোরাকারবারি, মজুতদার ও অসাধু ব্যবসায়ীদের প্রভাব কমাতে দাম নির্ধারণ জরুরি ছিল।

🔹 ৪. সাধারণ জনগণের স্বস্তি নিশ্চিত:
দাম বেড়ে গেলে জনগণের অসন্তোষ বাড়ে, তাই দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখা ছিল রাজনীতির অংশ।

⚙️ মূল্য নিয়ন্ত্রণ নীতি প্রয়োগের পদ্ধতি:

🔸 ১. নির্দিষ্ট দপ্তর গঠন:
👉 তিনি “দিওয়ান-ই-রিয়াসত” নামে একটি পৃথক বিভাগ গঠন করেন, যা বাজার নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে ছিল।

🔸 ২. বাজারে নির্দিষ্ট মূল্য নির্ধারণ:
👉 চাল, ডাল, কাপড়, লবণ, তেল, মাংস, ঘোড়া, অস্ত্র ইত্যাদি সব কিছুর নির্ধারিত দাম নির্ধারণ করা হয়।

🔸 ৩. বাজার তদারকির জন্য অফিসার নিয়োগ:
👉 প্রতিটি বাজারে শাহনা নামক এক কর্মকর্তা থাকতেন যিনি দ্রব্যের দাম ও মজুত তদারকি করতেন।

🔸 4. মজুতদার ও অসাধু ব্যবসায়ীর উপর কঠোর ব্যবস্থা:
👉 অধিক লাভের আশায় দ্রব্য লুকিয়ে রাখলে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা ছিল।

🔸 ৫. গোপনচর ব্যবস্থার প্রচলন:
👉 প্রশাসনের গোপনচর বাজারে নজরদারি করত এবং রিপোর্ট দিত।

🔸 ৬. ওজন ও পরিমাপে একতা:
👉 সকল ব্যবসায় নির্দিষ্ট মাপ ও ওজন ব্যবহারে বাধ্যবাধকতা ছিল।

🌟 মূল্য নিয়ন্ত্রণ নীতির সুফল:

✅ সেনাবাহিনীর রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় হ্রাস পায়।
✅ জনগণ সাশ্রয়ী দামে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস পেত।
✅ বাজারে শৃঙ্খলা ও আইনশৃঙ্খলা বজায় থাকে।
✅ প্রশাসনের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা বাড়ে।

⚠️ সীমাবদ্ধতা ও ব্যর্থতা:

❌ এই নীতি শুধু দিল্লি ও শহরতলির বাজারেই কার্যকর ছিল।
❌ সুলতানের মৃত্যুর পরে নীতি ভেঙে পড়ে।
❌ এটি ছিল জবরদস্তিমূলক এবং দীর্ঘমেয়াদে টেকেনি।

🧾 উপসংহার:

আলাউদ্দিন খলজির মূল্য নিয়ন্ত্রণ নীতি ছিল দিল্লি সুলতানি আমলের অন্যতম প্রশাসনিক বৈপ্লবিক পদক্ষেপ। এতে তিনি প্রমাণ করেন যে দক্ষ প্রশাসন কেবল যুদ্ধজয় বা রাজ্যবিস্তারে সীমাবদ্ধ নয়, বরং অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণেও শাসকের দক্ষতা প্রকাশ পায়। এই নীতি সাময়িক হলেও মধ্যযুগীয় অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় তার প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। আলাউদ্দিনের এই দৃষ্টিভঙ্গি আজও অর্থনৈতিক ইতিহাসে এক আলোচিত বিষয়।

📝৬. মুহাম্মদ বিন তুঘলকের প্রশাসনিক সংস্কারগুলি আলোচনা করো

✅ উত্তর:

🔶 ভূমিকা:

মুহাম্মদ বিন তুঘলক (শাসনকাল: ১৩২৫ খ্রিস্টাব্দ – ১৩৫১ খ্রিস্টাব্দ) ছিলেন দিল্লি সুলতানি যুগের তুঘলক বংশের দ্বিতীয় শাসক। ইতিহাসে তিনি পরিচিত একজন জ্ঞানপিপাসু, সংস্কারমুখী কিন্তু ব্যর্থ রাজা হিসেবে। তাঁর শাসনকাল নানা ধরনের অভিনব প্রশাসনিক সংস্কার দ্বারা চিহ্নিত হলেও, কার্যকর রূপায়ণের অভাব এবং বাস্তবজ্ঞানহীনতার কারণে সেগুলির বেশিরভাগই ব্যর্থ হয়। ইতিহাসবিদ বার্নি তাঁকে বলেছেন—“A mixture of opposites”।

🏛️ মুহাম্মদ বিন তুঘলকের প্রধান প্রশাসনিক সংস্কারগুলি:

📌 ১. রাজধানী স্থানান্তর (Transfer of Capital):

🔸 তিনি রাজধানী দিল্লি থেকে দৌলতাবাদ (দাক্ষিণাত্য) স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নেন।
🔸 এর উদ্দেশ্য ছিল সাম্রাজ্যের দক্ষিণাংশের উপর অধিক নিয়ন্ত্রণ স্থাপন।
🔸 কিন্তু এই স্থানান্তর ছিল জবরদস্তিমূলক এবং সাধারণ জনগণের উপর চরম অত্যাচারমূলক।

❌ ফল: বহু লোক মৃত্যুবরণ করে, জনঅসন্তোষ বাড়ে, শেষপর্যন্ত তাঁকে দিল্লিতেই ফিরে আসতে হয়।

📌 ২. তাম্র ও রৌপ্য মুদ্রার প্রচলন (Token Currency):

🔸 খাঁটি ধাতব মুদ্রার পরিবর্তে তিনি তাম্র মুদ্রা প্রচলন করেন।
🔸 উদ্দেশ্য ছিল রাজকোষে সঞ্চয় বৃদ্ধি এবং ব্যয় হ্রাস।
🔸 মুদ্রা দেখতে সহজ ছিল, ফলে সাধারণ মানুষ ও অসাধু ব্যবসায়ীরা জাল মুদ্রা তৈরি করতে থাকে।

❌ ফল: বাজারে মূল্যহ্রাস ঘটে, বাণিজ্যব্যবস্থা ভেঙে পড়ে, এবং মুদ্রা প্রথার ওপর আস্থা হারিয়ে যায়।

📌 ৩. দাক্ষিণাত্যে অভিযান ও বিস্তার নীতি:

🔸 দক্ষিণ ভারতে মাদুরাই পর্যন্ত রাজ্য বিস্তারে আগ্রহ দেখান।
🔸 রাজস্ব আদায়ে তিনি কঠোর নীতি গ্রহণ করেন।
🔸 প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ দুর্বল হওয়ায় স্থানীয় রাজারা বিদ্রোহ করে।

❌ ফল: অনেক অংশ তাঁর নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।

📌 ৪. কৃষি সংস্কার ও কৃষকদের জন্য ঋণ প্রকল্প:

🔸 খরার সময় কৃষকদের সাহায্য করার জন্য রাজকোষ থেকে ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।
🔸 তিনি একটি কৃষি বিভাগ গঠন করেন—"দিওয়ান-ই-আমির কোহি"।
🔸 সরকার নিজেই খামার তৈরি করে চাষবাস করতে চেয়েছিল।

❌ ফল: দুর্নীতি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও প্রশাসনিক ব্যর্থতায় প্রকল্পটি ধ্বংস হয়।

📌 ৫. কর বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত:

🔸 দোআব অঞ্চলে (গঙ্গা-যমুনার মধ্যবর্তী এলাকা) কৃষিতে উৎপাদন বেশি হওয়ায় কর বৃদ্ধি করেন।
🔸 অথচ এই সময় অঞ্চলটি খরায় আক্রান্ত ছিল।

❌ ফল: কৃষক বিদ্রোহ করে, উৎপাদন কমে যায়, রাজস্ব আদায়ে বিঘ্ন ঘটে।

⚖️ প্রশাসনিক সংস্কারের মূল্যায়ন:

🔹 মুহাম্মদ বিন তুঘলক ছিলেন দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন ও উদ্ভাবনী চিন্তার অধিকারী শাসক।
🔹 কিন্তু তাঁর সংস্কারগুলি বাস্তবতাবিবর্জিত ছিল।
🔹 পরিকল্পনা ভালো হলেও সেগুলির বাস্তবায়ন ছিল দুর্বল এবং অগোছালো।

🧾 উপসংহার:

মুহাম্মদ বিন তুঘলকের প্রশাসনিক সংস্কারগুলি প্রমাণ করে তিনি ছিলেন একজন ব্যতিক্রমী ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী শাসক। তবে তাঁর সংস্কারগুলি ছিল সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে এবং বাস্তবতা বিবর্জিত। সঠিক পরিকল্পনা, জনমত, ও বাস্তবতার মূল্যায়ন ছাড়াই সংস্কার গ্রহণ করলে তা ব্যর্থ হয়—মুহাম্মদ বিন তুঘলক এই শিক্ষাই ইতিহাসে রেখে গেছেন। ইতিহাসে তিনি চিহ্নিত হন এক বিচিত্র চরিত্র হিসেবে—“যিনি চিন্তা করেছিলেন অনেক, কিন্তু কার্যকর করতে পারেননি।”

📝৭. মহাম্মদ বিন তুঘলকের মধ্যে কি বৈপরীত্বের সংমিশ্রণ দেখা দিয়েছিল তা আলোচনা করো।

✅ উত্তরঃ

🔶 ভূমিকা:

মুহাম্মদ বিন তুঘলক (১৩২৫–১৩৫১ খ্রিঃ) ছিলেন দিল্লি সুলতানি যুগের তুঘলক বংশের দ্বিতীয় ও সবচেয়ে বিতর্কিত শাসক। তিনি ছিলেন একাধারে বিদ্বান, যুক্তিবাদী, সংস্কারক, অথচ বাস্তববিচ্ছিন্ন ও নির্দয় শাসক। ইতিহাসবিদ ইবন বতুতা ও ফিরিশতার বর্ণনা অনুযায়ী, তিনি ছিলেন এক জটিল স্বভাবের অধিকারী ব্যক্তি যার চিন্তায় ও কার্যকর্মে বৈপরীত্বের স্পষ্ট উপস্থিতি ছিল। এজন্য বার্নি তাঁকে বলেছেন — “A mixture of opposites”, অর্থাৎ বৈপরীত্বের সংমিশ্রণ।

🧭 বৈপরীত্বের বিভিন্ন দিক:

📌 ১. বুদ্ধিমান অথচ বাস্তববিচ্ছিন্ন:

🔹 মুহাম্মদ বিন তুঘলক ছিলেন পাণ্ডিত্য ও তর্কে দক্ষ, গ্রীক দর্শন, গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান, ধর্মশাস্ত্রে গভীর জ্ঞান ছিল।
🔹 অথচ তাঁর নীতি ও কর্মপদ্ধতি ছিল অগোছালো এবং বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন।

📌 উদাহরণ: তাম্র মুদ্রা প্রচলন। চিন্তাটা ছিল আধুনিক, কিন্তু বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয়ে অর্থনীতিকে ধ্বংস করল।

📌 ২. উদারমনা অথচ রূঢ় ও নৃশংস:

🔹 তিনি হিন্দু-মুসলমান উভয়ের প্রতিই ধর্মীয় সহিষ্ণুতা দেখাতেন। নিজ সভায় পণ্ডিত, কবি, দার্শনিক রাখতেন।
🔹 কিন্তু শাসনব্যবস্থায় সামান্য অপরাধেও কঠোর শাস্তি দিতেন। সন্দেহমূলক বিদ্রোহ দমনেও ছিলেন নিষ্ঠুর।

📌 উদাহরণ: রাজধানী স্থানান্তরের আদেশ অমান্যকারী সাধারণ জনগণকেও দণ্ডিত করেন।

📌 ৩. উদ্ভাবক অথচ অদূরদর্শী:

🔹 তাঁর প্রশাসনিক পরিকল্পনাগুলি ছিল চিন্তাশীল এবং অগ্রসর ধরণের।
🔹 কিন্তু কোনটি কবে, কোথায়, কীভাবে প্রয়োগ করতে হবে তা বুঝতেন না।

📌 উদাহরণ: কৃষকদের ঋণ প্রদান এবং কৃষি বিভাগের গঠন চমৎকার পরিকল্পনা হলেও দুর্নীতিপরায়ণ কর্মকর্তাদের হাতে তা ধ্বংস হয়।

📌 ৪. ধার্মিক অথচ ধর্মীয় শাস্ত্রে অননুগামী:

🔹 তিনি নিয়মিত নামাজ পড়তেন, ধর্মবিশ্বাসী ছিলেন।
🔹 কিন্তু ধর্মীয় নেতাদের উপদেশকে সবসময় গুরুত্ব দিতেন না এবং রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে নিজের যুক্তিকে প্রাধান্য দিতেন।

📌 ৫. বিজ্ঞানমনস্ক অথচ কুসংস্কারে বিশ্বাসী:

🔹 তিনি খগোলবিদ্যা ও গণিতে পারদর্শী ছিলেন।
🔹 কিন্তু নানা ভবিষ্যদ্বাণী ও অলৌকিকতার প্রতি আকৃষ্ট হতেন, যেমন—রাজধানী স্থানান্তরে জ্যোতির্বিদ্যার আশ্রয় নেন।

⚖️ মূল্যায়ন:

মুহাম্মদ বিন তুঘলকের চিন্তাভাবনা আধুনিক হলেও, তাঁর সিদ্ধান্ত ছিল সময়ের তুলনায় অনেক এগিয়ে এবং অপরিণামদর্শী। তাঁর ভিতরে একদিকে যেমন সংস্কারক মনোভাব ছিল, তেমনি ছিল নিষ্ঠুরতা ও অহংকার।

📚 ইতিহাসবিদদের মতে, তিনি ছিলেন একজন “Visionary without practical wisdom.” তাঁর ব্যর্থতা ছিল প্রয়োগ ও নেতৃত্বে।

🔚 উপসংহার:

মুহাম্মদ বিন তুঘলক ছিলেন ইতিহাসের এক চমকপ্রদ চরিত্র, যার শাসনকাল জুড়ে পরস্পরবিরোধী গুণের সমাবেশ লক্ষ করা যায়। বিদ্যা ও নৃশংসতা, উদারতা ও নির্দয়তা, চিন্তা ও কর্মে দ্বৈততা — সব মিলিয়ে তিনি এক ‘বৈপরীত্বের শাসক’। তাঁর শাসন ইতিহাসকে যেমন চমকিত করেছে, তেমনি দুঃখের শিক্ষাও দিয়ে গেছে— ভালো চিন্তা যথাযথ প্রয়োগ ছাড়া সফলতা আনে না।

📝 ৮. বিদেশি পর্যটকদের বিবরণ থেকে বিজয়নগর সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা বর্ণনা করো।

✅ উত্তরঃ

🔶 ভূমিকা:

দাক্ষিণাত্যে প্রতিষ্ঠিত বিজয়নগর সাম্রাজ্য (১৩৩৬–১৬৪৬ খ্রিঃ) ছিল মধ্যযুগীয় ভারতের অন্যতম সমৃদ্ধ ও সুসংগঠিত সাম্রাজ্য। এই সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাঠামো সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য আমরা পাই বিদেশি পর্যটকদের বিবরণ থেকে। বিশেষ করে নিকোলো কন্টি (ইতালি), আবদুর রাজ্জাক (পারস্য), ডোমিঙ্গো পায়েস ও ফেরনাও নুনিজ (পর্তুগাল) — এঁদের বিবরণ বিজয়নগরের সমৃদ্ধ সংস্কৃতি, সমাজ ও অর্থনীতির একটি জীবন্ত চিত্র তুলে ধরে।

🪙 বিজয়নগর সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক অবস্থা:

📌 ১. কৃষিনির্ভর অর্থনীতি:

• পর্যটকদের মতে, বিজয়নগর ছিল অত্যন্ত উর্বর ও কৃষিপ্রধান অঞ্চল।

• আবদুর রাজ্জাক লিখেছেন— “এই সাম্রাজ্যে বিশাল কৃষিজমি ছিল যা সেচব্যবস্থার মাধ্যমে চাষযোগ্য করা হয়েছিল।”

• চাষবাসের জন্য নদীর জল ব্যবহার ও কুয়ো, খাল এবং বাঁধ নির্মাণের কথা পাওয়া যায়।

📌 ২. শিল্প ও কারুশিল্প:

• পর্তুগিজ পর্যটক ডোমিঙ্গো পায়েস-এর মতে, রাজ্যে বিভিন্ন ধরনের শিল্প, যেমন—বস্ত্রশিল্প, ধাতুকর্ম, অলংকার নির্মাণ ইত্যাদি ছিল খুব উন্নত।

• বিশেষ করে সিল্ক, তুলা, অস্ত্র, মুদ্রা ও গয়না রপ্তানিযোগ্য শিল্পপণ্য ছিল।

📌 ৩. বাণিজ্য ও বাজারব্যবস্থা:

• বিজয়নগরের বাণিজ্য ছিল দেশীয় ও আন্তর্জাতিক।

• আবদুর রাজ্জাক বলেন: “বিজয়নগরের বাজারে এত সামগ্রী ছিল যে মনে হতো বিশ্বের সব কিছু এখানেই মেলে।”

• সমুদ্রবন্দরগুলির মাধ্যমে আরব, পারস্য, চীন ও ইউরোপের সঙ্গে বাণিজ্য চলত।

📌 ৪. মুদ্রা ও রাজস্ব:

• রাজ্যে স্বর্ণ, রূপা ও তামার মুদ্রা প্রচলিত ছিল। করব্যবস্থা ছিল সুসংগঠিত।

• পর্যটকদের মতে, রাজস্ব আদায় হতো জমি অনুযায়ী। এছাড়া, বাণিজ্য ও শুল্ক থেকেও রাজস্ব আসত।

🧭 বিজয়নগর সাম্রাজ্যের সামাজিক অবস্থা:

📌 ১. শ্রেণিবিভাজন ও বর্ণব্যবস্থা:

• সমাজে সুস্পষ্ট বর্ণব্যবস্থা বিদ্যমান ছিল— ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র।

• পর্যটক কন্টি ও পায়েস উল্লেখ করেন, সামাজিক স্তরবিন্যাস ছিল খুব কড়া।

📌 ২. নারীর অবস্থা:

• উচ্চবর্ণের নারীরা সাধারণত গৃহকর্মে সীমাবদ্ধ থাকলেও কিছু শিক্ষিত নারী সাহিত্য ও সংগীতচর্চায় যুক্ত ছিলেন।

• তবে সতীদাহ প্রথা ও বাল্যবিবাহ-এর উল্লেখ ডোমিঙ্গো পায়েস-এর বিবরণে দেখা যায়।

📌 ৩. ধর্মীয় সহাবস্থান:

• যদিও রাজা হিন্দু ছিলেন, মুসলমান ব্যবসায়ীদের প্রতি সহনশীল ছিলেন।

• মন্দিরপূজা, উৎসব, ও ধর্মীয় আচার ছিল সমাজজীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

📌 ৪. নগরজীবন ও নির্মাণশৈলী:

• বিজয়নগর ছিল এক মহা-নগরী। পর্যটকরা লেখেন— “এ শহরের প্রাসাদ, মন্দির ও রাজপথ দেখে ইউরোপের শহরগুলো ছোট মনে হয়।”

• মন্দির, প্রাসাদ, উদ্যান ইত্যাদি ছিল রাজকীয় গঠনে নির্মিত।

📌 ৫. উৎসব ও সংস্কৃতি:

• সাংস্কৃতিক জীবন ছিল অত্যন্ত সমৃদ্ধ।

• সঙ্গীত, নৃত্য, নাট্য এবং ধর্মীয় উৎসব ছিল সমাজজীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

📝 উপসংহার:

বিদেশি পর্যটকদের বিবরণ থেকে স্পষ্ট যে বিজয়নগর সাম্রাজ্য ছিল অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ, শিল্প ও বাণিজ্যে অগ্রণী এবং সামাজিকভাবে সুসংগঠিত। কৃষিভিত্তিক এই সাম্রাজ্য সাংস্কৃতিক ঐশ্বর্যেও ছিল অনন্য। বিদেশি পর্যটকদের লেখায় যে বিশাল, সমৃদ্ধ, ও সুশৃঙ্খল এক রাষ্ট্রের রূপ উঠে আসে, তা মধ্যযুগীয় ভারতের ইতিহাসে বিজয়নগরকে গৌরবের আসনে অধিষ্ঠিত করেছে।

<<<<<<<<<<<<<<<🌹 সমাপ্ত 🌹>>>>>>>>>>>