🌹বি.এ সেমিষ্টার-৪::মেজর ইতিহাস(পেপার-২)+মাইনর ইতিহাস সাজেশন(PART-2)🌹

  

✍️প্রশ্নের মান-৫: 

📝 ১. দিল্লি সুলতানি সাম্রাজ্যের পতনের কারণ আলোচনা করো।

✅ উত্তর:

দিল্লি সুলতানি (১২০৬–১৫২৬ খ্রিঃ) ছিল ভারতের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মুসলিম রাজবংশীয় শাসনব্যবস্থা। তুর্কি দাস শাসকদের হাত ধরে সূচনা হওয়া এই সাম্রাজ্য দীর্ঘ সময় ধরে বিভিন্ন শাসকগোষ্ঠীর দ্বারা পরিচালিত হয়—যেমন মামলুক, খলজি, তুঘলক, সায়্যিদ ও লোদি বংশ। তবে ১৫২৬ সালে পানিপথের প্রথম যুদ্ধে বাবরের হাতে ইব্রাহিম লোদি পরাজিত হলে দিল্লি সুলতানি সাম্রাজ্যের অবসান ঘটে। এই পতনের পেছনে একাধিক রাজনৈতিক, সামরিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক কারণ ছিল। নিচে তা বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করা হলো:

---

✅ (i) দুর্বল ও অযোগ্য শাসকদের শাসন

• দিল্লি সুলতানির শেষদিকে ইব্রাহিম লোদি-সহ বহু শাসক ছিল দুর্বল, স্বৈরাচারী ও অযোগ্য।

• তারা প্রশাসনিক দক্ষতা, সামরিক কৌশল ও জনসমর্থন অর্জনে ব্যর্থ হন।

✅ (ii) প্রাদেশিক গভর্নরদের বিদ্রোহ

• বহুবার গভর্নররা কেন্দ্রীয় সরকারের অবাধ্য হয়ে স্বাধীনতা দাবি করে বিদ্রোহে লিপ্ত হন।

• বঙ্গ, দক্‌খিন, গুজরাট প্রভৃতি অঞ্চলে স্বশাসন প্রতিষ্ঠা সুলতানির নিয়ন্ত্রণ দুর্বল করে দেয়।

✅ (iii) উত্তরাধিকার সংকট ও গৃহযুদ্ধ

• বিভিন্ন বংশে উত্তরাধিকার নির্ধারণে সুস্পষ্ট নিয়ম না থাকায় গৃহযুদ্ধ বাধে।

• অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও রক্তপাত রাজনীতি দুর্বল করে।

✅ (iv) প্রশাসনিক দুর্বলতা ও দুর্নীতি

• আমির, উমরা ও প্রশাসনিক কর্তার মধ্যে ব্যাপক দুর্নীতি ছিল।

• কেন্দ্রীয় শাসনের নিয়ন্ত্রণ দুর্বল হওয়ায় রাজস্ব আদায়ে সমস্যা দেখা দেয়।

✅ (v) আফগান ও রাজপুতদের প্রতিরোধ

• রাজপুত, বিজয়নগর, বাহমানি ও অন্যান্য হিন্দু রাজারা সুলতানির বিরুদ্ধে ক্রমাগত বিদ্রোহ করেন।

• আফগান প্রধানদের মধ্যে ঐক্যের অভাব ও বিদ্রোহ সাম্রাজ্য দুর্বল করে তোলে।

✅ (vi) অর্থনৈতিক দুরবস্থা

• কৃষিতে অব্যবস্থা, অনিয়ন্ত্রিত করনীতি, দুর্ভিক্ষ ও দুর্নীতির কারণে অর্থনীতি দুর্বল হয়ে পড়ে।

• জনগণের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়, যা রাজনৈতিক অস্থিরতা ডেকে আনে।

✅ (vii) তিমুরের আক্রমণ (১৩৯৮)

• তিমুর লং-এর দিল্লি আক্রমণ নগর ও সাম্রাজ্যের কাঠামোকে ধ্বংস করে দেয়।

• এরপর দিল্লি দীর্ঘ সময় ধরে পুনরুদ্ধার করতে পারেনি এবং দুর্বল হয়ে পড়ে।

✅ (viii) সামরিক শক্তির অবক্ষয়

• আধুনিক অস্ত্র ও প্রযুক্তির অভাবে দিল্লির সেনাবাহিনী মুঘলদের তুলনায় পিছিয়ে পড়ে।

• ইব্রাহিম লোদি পরাজিত হন বাবরের আধুনিক কামান ও কৌশলের কাছে।

✅ (ix) জনগণের সমর্থনের অভাব

• সুলতানদের অত্যাচারী ও স্বেচ্ছাচারী শাসন সাধারণ মানুষের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করে।

• স্থানীয় জনতা ও নেতারা মুঘলদের আগমনে উৎসাহ দেখায়।

---

✅ উপসংহার:

দিল্লি সুলতানির পতন ছিল বহুদিনের রাজনৈতিক দুর্বলতা, প্রশাসনিক অবক্ষয়, সামাজিক অসন্তোষ এবং বহিরাক্রমণের যৌথ ফলাফল। ১৫২৬ সালে বাবরের বিজয়ের মধ্য দিয়ে দিল্লি সুলতানি যুগের অবসান ঘটে এবং ভারতের ইতিহাসে মুঘল সাম্রাজ্যের সূচনা হয়। তবে দিল্লি সুলতানি তার সময়ে ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলামিক সংস্কৃতি, ভাষা ও স্থাপত্যে গভীর প্রভাব ফেলেছিল, যা ভবিষ্যতের ইতিহাসকে গঠনে সাহায্য করে।

📝 ২. দিল্লি সুলতানি যুগের অবক্ষয়ের জন্য ফিরোজ শাহ তুঘলক কতখানি দায়ী ছিল তা বর্ণনা করো।

✅ উত্তর:

দিল্লি সুলতানি যুগে ফিরোজ শাহ তুঘলক (শাসনকাল: ১৩৫১–১৩৮৮ খ্রি.) ছিলেন তুঘলক বংশের তৃতীয় শাসক। তার শাসন ছিল তুলনামূলক শান্তিপূর্ণ ও দীর্ঘ। ফিরোজ শাহ প্রশাসনে বহু সংস্কারমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন, যেমন—কর হ্রাস, দরিদ্রদের জন্য সাহায্য, শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি। তবে ইতিহাসবিদদের মতে, তার কিছু নীতিগত ও প্রশাসনিক দুর্বলতার কারণেই দিল্লি সুলতানি ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ে এবং অবশেষে তিমুরের আক্রমণে চূড়ান্ত অবক্ষয় ঘটে। নিচে ফিরোজ শাহ তুঘলকের দায়িত্ব কতখানি ছিল, তা বিশ্লেষণ করা হলো:

---

✅ (i) সামরিক শৌর্যের অভাব

• ফিরোজ শাহ ছিলেন শান্তিপ্রিয় ও যুদ্ধবিমুখ শাসক।

• তিনি কোনও বড় যুদ্ধ বা সাম্রাজ্য বিস্তারের চেষ্টা করেননি, ফলে সাম্রাজ্যের ভৌগোলিক বিস্তার থেমে যায় এবং কর্তৃত্ব হ্রাস পায়।

✅ (ii) প্রাদেশিক শাসন দুর্বল হয়ে পড়া

• তিনি অনেক প্রদেশের শাসকদের উপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেননি।

• তার মৃত্যুর পরে গভর্নররা স্বায়ত্তশাসনের দাবি তোলে, ফলে সাম্রাজ্যের একতা ক্ষুণ্ণ হয়।

✅ (iii) বংশানুক্রমিক চাকরি প্রথা চালু

• ফিরোজ শাহ প্রশাসনে ইক্তাদারি ব্যবস্থা বংশানুক্রমে হস্তান্তরের নীতি গ্রহণ করেন।

• এর ফলে অযোগ্য ব্যক্তিরা প্রশাসনিক পদে আসীন হয়ে প্রশাসন দুর্বল করে ফেলে।

✅ (iv) হিন্দুদের প্রতি কঠোর নীতি

• আগের তুলনায় তিনি হিন্দুদের প্রতি অনেক বেশি কঠোর ছিলেন।

• কর বৃদ্ধি, ধর্মান্তর প্রথা এবং মূর্তি ভাঙা—এসব পদক্ষেপ হিন্দুদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করে এবং বিদ্রোহের পথ তৈরি করে।

✅ (v) আর্থিক নীতির সমস্যা

• তার সময়ে কর ব্যবস্থায় কিছু সংস্কার করা হলেও অতিরিক্ত কর আরোপ করে সাধারণ কৃষকদের কষ্টে ফেলা হয়।

• পাশাপাশি, বহু ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে রাজস্ব মুকুবের কারণে রাজকোষে ঘাটতি দেখা দেয়।

✅ (vi) প্রশাসনিক সংস্কার সীমাবদ্ধ ছিল

• ফিরোজ শাহ অনেক সংস্কার করলেও তা দীর্ঘমেয়াদে টেকসই হয়নি।

• তার শাসনকাল শেষে আবার বিশৃঙ্খলা ফিরে আসে, কারণ তিনি দক্ষ উত্তরসূরি রেখে যাননি।

✅ (vii) শিক্ষায় ও ধর্মে অতিরিক্ত ব্যয়

• ফিরোজ শাহ বহু মাদ্রাসা, মসজিদ, ধর্মীয় গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করেন এবং এসব রক্ষণাবেক্ষণে বিপুল ব্যয় হয়।

• ফলে প্রশাসনিক ব্যয় ও সামরিক প্রস্তুতিতে বিনিয়োগ হ্রাস পায়।

✅ (viii) উত্তরসূরি সংকট ও অভ্যন্তরীণ গৃহযুদ্ধ

• ফিরোজ শাহ তার জীবদ্দশায়ই প্রাসাদ রাজনীতিতে দুর্বলতা প্রদর্শন করেন।

• তার মৃত্যুর পরপরই উত্তরাধিকার নিয়ে দ্বন্দ্ব শুরু হয় এবং রাজ্য গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে।

---

✅ (ix) তিমুরের আক্রমণের পূর্বভূমি তৈরি

• ফিরোজ শাহের শাসনকালে সুলতানি সাম্রাজ্য দুর্বল ও অবিন্যস্ত হয়ে পড়ে।

• ফলত ১৩৯৮ খ্রিঃ-এ তিমুর লং সহজেই দিল্লি আক্রমণ করে ব্যাপক ধ্বংস সাধন করতে সক্ষম হয়।

---

✅ উপসংহার:

ফিরোজ শাহ তুঘলক একজন সংস্কারক শাসক ছিলেন, তবে তার কিছু নীতিগত দুর্বলতা ও প্রশাসনিক সীমাবদ্ধতা দিল্লি সুলতানির মৌলিক কাঠামো দুর্বল করে তোলে। তার যুদ্ধবিমুখতা, অদক্ষ উত্তরাধিকারীদের রেখে যাওয়া, ও ধর্মীয় কট্টরতা দিল্লি সুলতানির পতনের পথ সুগম করে দেয়। সুতরাং বলা যায়, দিল্লি সুলতানি যুগের অবক্ষয়ের জন্য ফিরোজ শাহ তুঘলক কিছুটা হলেও দায়ী, বিশেষত প্রশাসনিক অব্যবস্থা ও রাজনৈতিক বিচক্ষণতার অভাবের জন্য। তবে এককভাবে তাকে দায়ী না করে, বৃহত্তর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে তাকে বিশ্লেষণ করাই যুক্তিসঙ্গত।

📝 ৩. ফিরোজ শাহ তুঘলককে দিল্লির সুলতানি যুগের 'আকবর' বলা কতটা যুক্তিযুক্ত, তা আলোচনা করো।
(600 শব্দে বিস্তারিত আলোচনা)

✅ উত্তর:

ভারতের ইতিহাসে আকবর ছিলেন মুঘল সাম্রাজ্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শাসক, যিনি প্রশাসনিক দক্ষতা, ধর্মীয় সহনশীলতা ও সংস্কারমূলক নীতির জন্য খ্যাত। অপরদিকে, ফিরোজ শাহ তুঘলক (১৩৫১–১৩৮৮ খ্রি.) তুঘলক বংশের একজন গুরুত্বপূর্ণ শাসক ছিলেন, যিনি তুলনামূলক শান্তিপূর্ণ শাসন প্রদান করেন এবং বহু প্রশাসনিক ও সামাজিক সংস্কার করেন। ফলে অনেক ইতিহাসবিদ তাকে দিল্লি সুলতানি যুগের 'আকবর' আখ্যা দিয়েছেন। তবে এই তুলনা কতটা যুক্তিযুক্ত, তা আলোচনা করতে হলে দুজন শাসকের কার্যকলাপ, নীতি ও দর্শন তুলনা করে বিচার করতে হয়।

---

✅ (i) প্রশাসনিক দক্ষতা ও সংস্কারমূলক মানসিকতা

• ফিরোজ শাহ তুঘলক বিভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংস্কার গ্রহণ করেছিলেন—যেমন কর হ্রাস, দরিদ্রদের সহায়তা, রাস্তা, খাল, হাসপাতাল ও মাদ্রাসা নির্মাণ।

• আকবরও রাজস্বনীতি (টোডরমলের বানানো), সুবা ব্যবস্থা, মান-সবদারি প্রথা চালু করেন।
  🔎 উপসংহার: প্রশাসনিক সংস্কারের দিক থেকে ফিরোজ শাহ তুঘলকের আকবরসদৃশ বৈশিষ্ট্য ছিল।

---

✅ (ii) ধর্মীয় নীতি ও সহনশীলতা

• ফিরোজ শাহ একজন ধর্মপরায়ণ মুসলমান ছিলেন, তবে তিনি হিন্দুদের উপর কঠোর ছিলেন। বহু হিন্দু মন্দির ভাঙা হয় এবং জিজিয়া কর পুনরায় আরোপ করা হয়।

• অপরদিকে আকবর ছিলেন অসাম্প্রদায়িক, ‘দীন-ই-ইলাহী’ প্রচলন করেন এবং হিন্দু-মুসলমান ঐক্য গড়ে তোলার চেষ্টা করেন।
  🔎 উপসংহার: ধর্মীয় সহিষ্ণুতার দিক থেকে ফিরোজ শাহ আকবরের তুলনায় অনেক পিছিয়ে ছিলেন।

---

✅ (iii) শিক্ষা ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা

• ফিরোজ শাহ বহু মাদ্রাসা, পাঠশালা, গ্রন্থাগার নির্মাণ করেন এবং জ্ঞানচর্চায় উৎসাহ দেন।

• আকবরও জ্ঞানচর্চায় অত্যন্ত উৎসাহী ছিলেন এবং ফারসি, সংস্কৃত, আরবি ইত্যাদি ভাষায় অনুবাদের কাজ করান।
  🔎 উপসংহার: জ্ঞান ও শিক্ষা প্রসারে উভয়ের মধ্যেই মিল ছিল, যদিও আকবর ছিলেন অধিক বহুমাত্রিক ও উদার।

---

✅ (iv) জনহিতকর কর্মসূচি

• ফিরোজ শাহের শাসনে অনাথ, দরিদ্র, বিধবা, রোগীদের জন্য হাসপাতাল, আশ্রম, কর্মসংস্থান ব্যবস্থা চালু হয়।

• আকবরও জনগণের জীবনমান উন্নয়নে ভূমিকা রাখেন, যেমন কৃষক সহায়তা, ধর্মীয় স্বাধীনতা ইত্যাদি।
  🔎 উপসংহার: দুজনই জনকল্যাণমূলক শাসনের উদাহরণ তৈরি করেছিলেন।

---

✅ (v) যুদ্ধ ও সাম্রাজ্য বিস্তারে মনোযোগ

• ফিরোজ শাহ শান্তিপ্রিয় ছিলেন এবং সাম্রাজ্য বিস্তারে আগ্রহ কম ছিল। তিনি যুদ্ধ এড়িয়ে চলতেন।

• অপরদিকে আকবর ছিলেন কুশলী সেনানায়ক, যিনি রাজপুত ও আফগানদের দমন করে সাম্রাজ্য সম্প্রসারণে সফল হন।
  🔎 উপসংহার: এই দিক থেকে ফিরোজ শাহ আকবরের তুলনায় অনেক দুর্বল।

---

✅ (vi) উত্তরসূরি নির্বাচন ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা

• ফিরোজ শাহ কার্যকর উত্তরসূরি রেখে যেতে ব্যর্থ হন, ফলে মৃত্যুর পরে সাম্রাজ্যে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়।

• আকবর জাহাঙ্গীরকে দক্ষভাবে প্রশিক্ষণ দিয়ে উত্তরাধিকার নিশ্চিত করেন।
  🔎 উপসংহার: রাজনৈতিক দূরদর্শিতায় ফিরোজ শাহের তুলনায় আকবর ছিলেন অনেক বেশি দক্ষ।

---

✅ উপসংহার:

ফিরোজ শাহ তুঘলক ছিলেন দিল্লি সুলতানি যুগের একজন সমাজ-মনস্ক ও সংস্কারক শাসক। প্রশাসনিক দক্ষতা, জনহিতকর কর্মকাণ্ড ও শিক্ষা বিস্তারে তার অবদান আকবরের মতই প্রশংসনীয়। তবে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা, যুদ্ধবিমুখতা, সাম্রাজ্য বিস্তারে অনাগ্রহ এবং দুর্বল উত্তরসূরি নির্বাচনের কারণে তাকে আকবরের সমতুল্য বলা সম্পূর্ণ যুক্তিযুক্ত নয়।

📌 মূল মূল্যায়ন:
ফিরোজ শাহ তুঘলককে দিল্লির 'আকবর' বলা কিছু নির্দিষ্ট দিক থেকে আংশিক সঠিক হলেও পূর্ণাঙ্গভাবে তুলনাটি অতিরঞ্জিত ও সীমিত।

📝 ৪. ফিরোজ শাহ তুঘলকের জনহিতকর কার্যাবলী বা সংস্কারগুলি বর্ণনা করো।

✅ উত্তর:

ফিরোজ শাহ তুঘলক (১৩৫১–১৩৮৮ খ্রি.) ছিলেন দিল্লি সুলতানি যুগের তুঘলক বংশের তৃতীয় ও অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শাসক। তার শাসনকাল ছিল তুলনামূলকভাবে শান্তিপূর্ণ ও দীর্ঘ। সমসাময়িক শাসকদের তুলনায় তিনি ছিলেন উদার, মানবিক এবং সংস্কারমনস্ক শাসক। সমাজকল্যাণ, প্রশাসনিক সংস্কার, কৃষি উন্নয়ন, শিক্ষা বিস্তার এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে তার অবদান তাকে বিশেষ মর্যাদার আসনে বসিয়েছে। নিচে তার জনহিতকর কার্যাবলী ও সংস্কারগুলি ধারাবাহিকভাবে আলোচনা করা হলো—

---

✅ (i) কর সংস্কার

• ফিরোজ শাহ কৃষকদের দুর্দশা লাঘবে কর ব্যবস্থা সংস্কার করেন।

• তিনি খাজনার হার নির্দিষ্ট করে দেন এবং অধিক কর আদায়ে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন।

• চাষযোগ্য জমি ও ফসল অনুযায়ী কর ধার্য হয়, ফলে কৃষকদের উপর চাপ কমে যায়।
  🔎 মূল লক্ষ্য ছিল কৃষকের কল্যাণ ও রাজস্ব ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা আনয়ন।

---

✅ (ii) কৃষি ও সেচ ব্যবস্থার উন্নয়ন

• কৃষির উন্নয়নে তিনি বহু খাল, জলাধার ও বাঁধ নির্মাণ করেন।

• “যমুনা খাল” ও “সুতলজ খাল” ছিল তার শাসনকালের উল্লেখযোগ্য প্রকল্প।

• নতুন চাষযোগ্য জমি আবিষ্কার ও অনাবাদি জমিতে কৃষিকাজ শুরু হয়।
  🔎 এই পদক্ষেপ খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি ও রাজকোষ সমৃদ্ধ করতে সহায়ক হয়।

---

✅ (iii) দাসপ্রথা ও শ্রমনীতি

• ফিরোজ শাহ প্রায় ১,৮০,০০০ দাস সংগ্রহ করে তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে বিভিন্ন কাজে নিয়োগ করেন।

• এই দাসদের জন্য আবাসন, খাদ্য ও বেতন নিশ্চিত করেন।

• তিনি দাসদের সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে পুনর্বাসন দেন।
  🔎 এর মাধ্যমে শ্রমব্যবস্থা নিয়ন্ত্রিত হয় এবং বেকারত্ব হ্রাস পায়।

---

✅ (iv) জনহিতকর স্থাপনা নির্মাণ

• তিনি বহু হাসপাতাল (দারুশ শিফা), আশ্রয়কেন্দ্র, মাদ্রাসা, সরাইখানা ও কূপ নির্মাণ করেন।

• বিভিন্ন শহরে অতিথিশালা, পথচারীদের বিশ্রামের জন্য চৌকি স্থাপন করেন।

• তার নির্মিত অনেক খুতবা, দরগা ও মসজিদ আজও ঐতিহাসিক নিদর্শন।
  🔎 এগুলো সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা উন্নত করে।

---

✅ (v) শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান পৃষ্ঠপোষকতা

• ফিরোজ শাহ বহু মাদ্রাসা ও পাঠশালা স্থাপন করেন, যেখানে কোরআন, হাদিস ও ফারসি সাহিত্য পড়ানো হতো।

• পণ্ডিত ও শিক্ষকদের জন্য ভাতা নির্ধারণ করা হয়।

• বহু মসজিদ ও ধর্মীয় গ্রন্থাগার নির্মাণ ও সংরক্ষণে উদ্যোগী হন।
  🔎 ধর্মীয় শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রসারে তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

---

✅ (vi) আইন সংস্কার

• ইসলামী শরিয়াহ আইনের কড়া প্রয়োগে তিনি বিশ্বাসী ছিলেন।

• তিনি শরিয়াহভিত্তিক বিচার ব্যবস্থা চালু করেন ও বিচারকদের নিয়োগ দেন।

• অপরাধ দমন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় এই পদক্ষেপ কার্যকর ছিল।
  🔎 তবে এতে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর কিছুটা কড়াকড়ি পড়ে।

---

✅ (vii) মুদ্রা সংস্কার

• ফিরোজ শাহ তাম্র ও রৌপ্য মুদ্রা প্রচলন করেন।

• তার সময় মুদ্রার মান নির্ধারণ ও জালিয়াতি রোধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

• ফলে বাজারে আর্থিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকে।
  🔎 বাণিজ্য ও আর্থিক লেনদেনে স্বচ্ছতা আসে।

---

✅ (viii) ভ্রাম্যমাণ হাসপাতাল ও চিকিৎসা

• ফিরোজ শাহ দারুশ শিফা প্রতিষ্ঠা করেন যেখানে বিনামূল্যে চিকিৎসার ব্যবস্থা ছিল।

• দরিদ্র, পীড়িত ও দুঃস্থদের চিকিৎসা ও ওষুধ সরবরাহে তার সরকার দায়িত্ব নিত।
  🔎 এটি ছিল তখনকার সময়ে এক বিপ্লবাত্মক জনসেবা পদক্ষেপ।

---

✅ উপসংহার:

ফিরোজ শাহ তুঘলক ছিলেন সুলতানি যুগের অন্যতম সমাজহিতৈষী শাসক। তিনি শুধু প্রশাসনিকভাবে নয়, সামাজিক, ধর্মীয়, অর্থনৈতিক ও শিক্ষাগত ক্ষেত্রেও বহু যুগান্তকারী সংস্কার করেছিলেন। সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা, কৃষির উন্নয়ন ও শিক্ষা বিস্তারে তার অবদান স্মরণীয়। যদিও তিনি ধর্মীয়ভাবে কিছুটা কট্টর ছিলেন, তবু তার জনহিতকর কর্মসূচিগুলি তাকে এক মানবিক ও সংস্কারক শাসকে পরিণত করেছিল।

📌 ফলে বলা যায়, ফিরোজ শাহ তুঘলকের শাসন সুলতানি যুগে একটি ইতিবাচক সামাজিক পরিবর্তনের সূচনা করে।

📝 ৪. সুলতানা রাজিয়ার সম্মুখে প্রধান সমস্যাগুলি কী ছিল? কারা কারা তার শত্রু ছিল?

✅ উত্তর:

সুলতানা রাজিয়া (শাসনকাল: ১২৩৬–১২৪০ খ্রি.) ছিলেন ভারতের প্রথম এবং একমাত্র মহিলা সুলতান। তিনি ইলতুতমিশের কন্যা ও যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে দিল্লির সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। কিন্তু নারীরূপে শাসকের আসনে বসায় তার শাসনকাল জুড়ে নানা বাধা ও সংকট তাকে মোকাবিলা করতে হয়। বহু ঐতিহাসিকের মতে, তার বুদ্ধিমত্তা, প্রশাসনিক দক্ষতা ও সাহস থাকা সত্ত্বেও তাকে পতনের দিকে ঠেলে দেয় সমাজ, শাসকগোষ্ঠী ও অভিজাতদের যৌথ ষড়যন্ত্র। নিচে তার সম্মুখের প্রধান সমস্যাগুলি ও তার শত্রুদের পরিচয় বিশ্লেষণ করা হলো—

---

✅ (i) নারী শাসক হিসেবে সামাজিক প্রতিরোধ

• রাজিয়া একজন নারী ছিলেন এবং তা মধ্যযুগীয় মুসলিম সমাজে শাসনক্ষমতার জন্য গ্রহণযোগ্য ছিল না।

• মুসলিম অভিজাত ও ধর্মীয় গোষ্ঠী বিশ্বাস করত যে একজন নারী কখনো সুলতান হতে পারে না।

• ফলে তার শাসন প্রারম্ভ থেকেই নারীত্ব তার জন্য প্রধান প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়।
  🔎 এই প্রথাগত মনোভাব তার কর্তৃত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে।

---

✅ (ii) তুর্কি অভিজাত গোষ্ঠীর বিরোধিতা

• ইলতুতমিশের শাসনকালে গঠিত “চাহলগানি” বা ৪০ জন তুর্কি আমিরের দল ছিল অত্যন্ত প্রভাবশালী।

• তারা কোনো নারী শাসককে মানতে নারাজ ছিল এবং রাজিয়ার ক্ষমতা খর্ব করতে উঠে-পড়ে লাগে।

• তার রাজত্বের গোড়ার দিকেই এই অভিজাত গোষ্ঠী ষড়যন্ত্র করে বিদ্রোহ সৃষ্টি করে।
  🔎 এই চাহলগানি ছিল রাজিয়ার অন্যতম শক্তিশালী রাজনৈতিক শত্রু।

---

✅ (iii) ভাইদের বিদ্রোহ ও রাজ্যদাবি

• ইলতুতমিশের পুত্র রুকনউদ্দিন ফিরোজ প্রথমে সুলতান হন কিন্তু অযোগ্যতার কারণে বরখাস্ত হন।

• এরপর রাজিয়া সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হলেও অন্য ভাইরা তাদের রাজ্যদাবি নিয়ে বিদ্রোহ করে।

• খুসরু মালিক, মুহাম্মদ ও অন্যান্য ভাই রাজিয়াকে ক্ষমতাচ্যুত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়।
  🔎 পরিবারের মধ্যেই রাজিয়ার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু হয়।

---

✅ (iv) হাবশি আমির ইয়াকুতের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে বিতর্ক

• রাজিয়া তার বিশ্বস্ত সহযোগী ও দাস ইয়াকুত-কে ‘আমির-ই-আখুর’ পদে (ঘোড়া বাহিনীর প্রধান) উন্নীত করেন।

• রাজিয়া-ইয়াকুত সম্পর্ক নিয়ে অভিজাতদের মধ্যে অসন্তোষ ও গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে রাজিয়া একজন হাবশির প্রেমে পড়েছেন।

• এই ঘটনা তার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করে এবং তার বিরোধিতাকে আরও তীব্র করে তোলে।
  🔎 এই বিভ্রান্তি অভিজাতদের মধ্যে তাকে দুর্বল করার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

---

✅ (v) আলতুনিয়া বিদ্রোহ ও বিশ্বাসঘাতকতা

• মালিক আলতুনিয়া, তাবরিন রাজ্যের গভর্নর, রাজিয়ার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন।

• আলতুনিয়া ইয়াকুতকে হত্যা করে রাজিয়াকে বন্দি করেন এবং পরে রাজিয়ার সঙ্গে বিবাহ করেন।

• যদিও বিবাহের পরে রাজিয়া পুনরায় ক্ষমতা পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করেন, কিন্তু সেনাবাহিনী ততদিনে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়।
  🔎 আলতুনিয়ার বিশ্বাসঘাতকতা রাজিয়ার পতনের পথে বড় ধাক্কা দেয়।

---

✅ (vi) সেনাবাহিনীর আনুগত্যের অভাব

• অভিজাতদের বিরোধিতার প্রভাব সেনাবাহিনীর মনোবলে পড়ে এবং তারা রাজিয়ার আদেশে অনিচ্ছা প্রকাশ করতে শুরু করে।

• রাজিয়া ও আলতুনিয়া যখন দিল্লি পুনর্দখলের চেষ্টা করেন, তখন সেনারা যুদ্ধ ছেড়ে পালিয়ে যায়।

• ফলে তিনি যুদ্ধে পরাজিত হন ও আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হন।
  🔎 সেনার আনুগত্যহীনতা শেষ পরিণতি নির্ধারণ করে।

---

✅ (vii) রাজিয়ার মৃত্যু

• ১২৪০ খ্রিস্টাব্দে রাজিয়া ও আলতুনিয়া উভয়েই বন্দি অবস্থায় নিহত হন।

• কোনো অভিজাত বা সেনানায়ক তাকে বাঁচানোর উদ্যোগ নেয়নি।
  🔎 তার মৃত্যু ছিল রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র ও লিঙ্গবৈষম্যের চূড়ান্ত পরিণতি।

---

✅ উপসংহার:

সুলতানা রাজিয়া ছিলেন সাহসিনী, বিদুষী ও সুদক্ষ শাসক, যিনি পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নিজ যোগ্যতায় সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। কিন্তু তার বিরুদ্ধে লড়াই ছিল কেবল রাজনৈতিক নয়, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক প্রতিবন্ধকতারও। অভিজাত আমিরগণ, ভাইদের বিদ্রোহ, সেনার অবাধ্যতা এবং নারীত্বের প্রতি কুসংস্কার তাকে শেষ পর্যন্ত চরম পরিণতির দিকে ঠেলে দেয়।

📌 সুতরাং, সুলতানা রাজিয়ার প্রধান শত্রু ছিল চাহলগানি, বিদ্রোহী গভর্নররা, আত্মীয়-স্বজন, এবং সর্বোপরি মধ্যযুগীয় সমাজের নারী-বিদ্বেষী মানসিকতা।
তার সংগ্রাম ছিল শুধু সিংহাসনের জন্য নয়, নারী শাসকের স্বীকৃতির জন্যও এক ঐতিহাসিক লড়াই।

📝 ৫. ভক্তি আন্দোলন এবং সুফি আন্দোলনের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক তাৎপর্য বা গুরুত্ব বর্ণনা করো।

✅ উত্তর:

ভক্তি আন্দোলন ও সুফি আন্দোলন ছিল মধ্যযুগীয় ভারতের দুটি শক্তিশালী ধর্মীয় ও সামাজিক আন্দোলন, যা সমাজের ভেদাভেদ, ধর্মীয় গোঁড়ামি এবং জাতপাত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে এক নতুন মানবিক চেতনা সৃষ্টি করে। এই আন্দোলনগুলি কেবল ধর্মীয় ক্ষেত্রেই নয়, বরং ভারতের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছিল।

নিচে ভক্তি ও সুফি আন্দোলনের সামগ্রিক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব ব্যাখ্যা করা হলো—

---

✅ (i) জাতিভেদ ও সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ

• ভক্তি ও সুফি সাধকগণ সমাজে প্রচলিত জাতিভেদ, বর্ণবাদ, ধর্মীয় গোঁড়ামি এবং সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন।

• তাঁরা বলেছিলেন যে ঈশ্বর সকলের, এবং ঈশ্বরের কাছে কোনো জাত, ধর্ম বা বর্ণের ভেদ নেই।
  🔎 ফলে নিম্নবর্ণের মানুষ, বিশেষ করে শূদ্র ও দলিত শ্রেণির মানুষ, প্রথমবারের মতো ধর্মীয় সমানাধিকার লাভ করেন।

---

✅ (ii) হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি স্থাপন

• সুফি সাধকগণ ইসলাম ধর্মকে সহনশীল ও মানবতাবাদী রূপে প্রচার করেন।

• ভক্তি সাধকগণও হিন্দু ধর্মে অসাম্প্রদায়িক মানবিকতার বাণী প্রচার করেন।

• যেমন: কবীর, দাদু, গুরু নানক, চৈতন্যদেব, মীরাবাঈ প্রমুখ সাধক হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ গড়ে তুলেছিলেন।
  🔎 ফলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও ধর্মীয় সহনশীলতার চেতনা বিকশিত হয়।

---

✅ (iii) নারীসমাজের মর্যাদা বৃদ্ধি

• ভক্তি আন্দোলনের অনেক সাধিকা যেমন মীরাবাঈ, লালদেদ, করাইক্কাল আম্মাইyar ইত্যাদি নারী ছিলেন।

• তারা প্রমাণ করেছিলেন যে ঈশ্বরভক্তি ও আধ্যাত্মিকতা অর্জনে নারী ও পুরুষের ভেদ নেই।

• সুফিগণও নারীকে সম্মানের চোখে দেখার কথা বলেন।
  🔎 ফলে নারীশিক্ষা ও নারী স্বাধীনতা বিষয়ে সমাজে নতুন ভাবনার সূচনা হয়।

---

✅ (iv) আঞ্চলিক ভাষা ও সাহিত্যের উন্নয়ন

• এই আন্দোলনের সাধকরা সাধারন মানুষের ভাষায় ঈশ্বরচিন্তা ও ধর্মীয় বাণী প্রচার করতেন।

• ভক্তি আন্দোলন বাংলা, হিন্দি, তামিল, মারাঠি, কন্নড়, তেলুগু প্রভৃতি আঞ্চলিক ভাষার সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে।

• সুফিগণ ফারসি, উর্দু ও স্থানীয় উপভাষায় কবিতা রচনা করেন।
  🔎 ফলে ভারতীয় সাহিত্য ও সংস্কৃতির এক নতুন যুগের সূচনা ঘটে।

---

✅ (v) ধর্মীয় গোঁড়ামি ও ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরোধিতা

• ভক্তি সাধকেরা মন্দির, পুরোহিত ও আচার-অনুষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করে বলেন—"ভক্তিই ঈশ্বর লাভের একমাত্র পথ"।

• সুফি সাধকরা শরিয়াহ আইন এবং গোঁড়া মৌলবাদের চেয়েও হৃদয় ও প্রেমের ভিত্তিতে ধর্মকে গুরুত্ব দেন।
  🔎 ফলে এক ধরনের ধর্মীয় মুক্তচিন্তা সমাজে জায়গা করে নেয়।

---

✅ (vi) ধর্মীয় জীবনে ব্যক্তিগত অনুভূতির গুরুত্ব

• উভয় আন্দোলনেই ধর্মীয় অনুশীলনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল ব্যক্তিগত ভক্তি ও অনুভব।

• ঈশ্বরকে ভয় নয়, বরং ভালোবাসা ও হৃদয়ের দ্বারা অনুভব করা যায়—এই বাণী সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করে।
  🔎 ফলে ধর্মের অন্তর্মুখী, আত্মিক দিকটি গুরুত্ব পায়।

---

✅ (vii) মঠ ও দরগা ভিত্তিক সামাজিক কেন্দ্র গঠন

• ভক্তি সাধকেরা মঠ নির্মাণ করেন, যা ধর্মীয় শিক্ষা ও জনসেবা কেন্দ্র হিসেবে কাজ করত।

• সুফিগণ দরগা নির্মাণ করেন, যা ধর্মীয় মিলনস্থল ছাড়াও দান, সেবা ও শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করত।
  🔎 এই প্রতিষ্ঠানগুলি গ্রামীণ ও শহুরে সমাজে সংহতি ও মানবসেবার চেতনাকে প্রসারিত করে।

---

✅ উপসংহার:

ভক্তি ও সুফি আন্দোলন মধ্যযুগীয় ভারতে এক যুগান্তকারী পরিবর্তনের সূচনা করে। এরা কেবল ধর্মীয় জাগরণ আনেনি, বরং সমাজের বঞ্চিত ও উপেক্ষিত শ্রেণিকে নতুন মর্যাদা দিয়েছে, ভাষা-সাহিত্যের বিকাশ ঘটিয়েছে এবং ধর্মীয় সম্প্রীতির বীজ বপন করেছে। তাদের শিক্ষা আজও প্রাসঙ্গিক, কারণ তা আমাদের শেখায়—ভেদাভেদ নয়, মানবতা ও প্রেমই সত্যিকারের ধর্ম।

📌 সুতরাং, ভক্তি ও সুফি আন্দোলন ভারতের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসে এক অনন্য মাইলফলক রূপে চিহ্নিত হয়ে আছে।

📝 প্রশ্ন ৬. মোহাম্মদ বিন তুঘলকের মুদ্রা সংস্কার নীতি আলোচনা করো।

---

✅ উত্তর:

মোহাম্মদ বিন তুঘলক ছিলেন দিল্লি সুলতানি যুগের তৃতীয় তুঘলক শাসক, যিনি ১৩২৫ থেকে ১৩৫১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত শাসন করেন। তিনি একাধারে উচ্চাভিলাষী ও চিন্তাশীল শাসক হলেও তার নানা সংস্কার পরিকল্পনা বাস্তবতার বিচারে ব্যর্থ হয়। তার অন্যতম বিতর্কিত ও ব্যর্থ পরিকল্পনা ছিল মুদ্রা সংস্কার। এই নীতির উদ্দেশ্য, কার্যাবলী, এবং পরিণতি নিচে পর্যায়ক্রমে আলোচনা করা হলো—

---

✅ (i) মুদ্রা সংস্কারের পটভূমি:

• মোহাম্মদ বিন তুঘলক সাম্রাজ্য বিস্তার ও যুদ্ধ পরিচালনার জন্য বিপুল অর্থ ব্যয় করতেন।

• তাঁর রাজধানী বদল, খোরাসান অভিযানের প্রস্তুতি, এবং দুর্ভিক্ষের মোকাবিলায় প্রচুর ব্যয় হয়।

• এই আর্থিক চাপ সামাল দিতে তিনি প্রচলিত ধাতব মুদ্রার পরিবর্তে কম মূল্যবান ধাতুর মুদ্রা চালু করেন।

---

✅ (ii) মুদ্রা সংস্কারের বৈশিষ্ট্য:

• তিনি রূপা ও সোনার পরিবর্তে তাম্র মুদ্রা প্রচলন করেন।

• এই মুদ্রাগুলিকে সুলতানের পক্ষ থেকে সরকারি স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। এগুলিকে বলা হতো "টোকেন কারেন্সি"।

• তিনি আশা করেছিলেন, এতে ধনভাণ্ডারে স্বর্ণ ও রূপা সঞ্চিত থাকবে এবং তাম্র মুদ্রা দিয়ে বাণিজ্য চলবে।

---

✅ (iii) মুদ্রা সংস্কারের উদ্দেশ্য:

• আর্থিক ঘাটতি মেটানো।

• অধিক পরিমাণ মুদ্রা প্রচলনের মাধ্যমে বাজারে তারল্য বৃদ্ধি।

• রূপা-সোনার মজুদ সুরক্ষিত রেখে রাজকোষকে শক্তিশালী করা।

---

✅ (iv) ব্যর্থতার কারণ:

1. নকল মুদ্রা তৈরির সুযোগ:

   • জনগণের মধ্যে কোনো নিয়ন্ত্রণ বা সতর্কতা না থাকায় যে কেউ তাম্র মুদ্রা গড়ে প্রচলন করতে লাগল।

   • সরকারি ছাপ না থাকায় আসল ও নকল মুদ্রা আলাদা করা অসম্ভব হয়ে পড়ে।

2. অতিরিক্ত মুদ্রার প্রভাব:

   • বাজারে প্রচুর নকল মুদ্রা ছড়িয়ে পড়ে এবং মুদ্রার মান কমে যায়।

   • ব্যবসায়ীরা তাম্র মুদ্রা গ্রহণে অনীহা প্রকাশ করতে থাকে।

3. অবিশ্বাস ও মন্দার সৃষ্টি:

   • বাজারে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়, বাণিজ্যে ধস নামে।

   • রাজস্ব আদায় কঠিন হয়ে পড়ে।

---

✅ (v) সংস্কার প্রত্যাহার ও পরিণাম:

• মোহাম্মদ বিন তুঘলক শেষ পর্যন্ত মুদ্রা সংস্কার বাতিল করেন।

• তাম্র মুদ্রাগুলিকে ফেরত নিয়ে রূপা বা সোনার প্রকৃত মুদ্রা দিয়ে পরিবর্তনের নির্দেশ দেন।

• এতে রাজকোষ আরও ক্ষয়প্রাপ্ত হয় এবং আর্থিক বিপর্যয় চরমে পৌঁছে।

---

✅ (vi) ঐতিহাসিক মূল্যায়ন:

• ইতিহাসবিদ বার্নি ও ইলিয়ট মোহাম্মদ বিন তুঘলকের এই নীতিকে "একজন চিন্তাশীল পাগলের কাজ" বলেছেন।

• যদিও এটি আধুনিক কাগুজে মুদ্রার ধারণার পূর্বসূরী ছিল, কিন্তু সময় ও বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পারায় তা ব্যর্থ হয়েছে।

• মুদ্রা সংস্কার ছিল "উদ্দেশ্যে মহৎ, কিন্তু পরিকল্পনায় দুর্বল এবং বাস্তবায়নে বিভ্রান্ত"।

---

✅ (vii) উপসংহার:

মোহাম্মদ বিন তুঘলকের মুদ্রা সংস্কার তার প্রগাঢ় চিন্তাভাবনার পরিচয় দিলেও বাস্তবতা ও দক্ষ প্রশাসনের অভাবে তা ব্যর্থ হয়। ফলে দিল্লি সুলতানির আর্থিক অবস্থা ভীষণভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। এই ঘটনাটি মধ্যযুগীয় ভারতের এক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষনীয় অধ্যায় হিসেবেও বিবেচিত।

📝 প্রশ্ন ৭. বাংলার সাংস্কৃতিক জীবনে হুসেন শাহী বংশের তাৎপর্য বা গুরুত্ব আলোচনা করো।

✅ উত্তর:

হুসেন শাহী বংশ (1494–1538 খ্রিঃ) মধ্যযুগীয় বাংলার ইতিহাসে এক স্বর্ণযুগের সূচনা করেছিল। আলাউদ্দিন হুসেন শাহ ও তার পুত্র নাসিরউদ্দিন নুসরাত শাহের শাসনামলে বাংলার রাজনীতি, সাহিত্য, শিল্প, ধর্ম এবং শিক্ষা সংস্কৃতিতে এক অপূর্ব বিকাশ ঘটে। হুসেন শাহী বংশের শাসকগণ ছিলেন ধর্মনিরপেক্ষ, প্রজাবৎসল ও সংস্কৃতিপ্রেমী। বাংলার ইতিহাসে এ বংশের অবদান বহুস্তরীয়।

---

✅ (১) ধর্মনিরপেক্ষ শাসনব্যবস্থা

• হুসেন শাহী বংশের শাসকেরা হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সব ধর্মের মানুষের প্রতি সহনশীল নীতি গ্রহণ করেছিলেন।

• হিন্দুদের ওপর জিজিয়া কর তুলে দেওয়া হয় এবং হিন্দু মন্ত্রী ও কর্মকর্তা নিয়োগের মাধ্যমে ধর্মীয় সাম্য প্রতিষ্ঠা পায়।

➡️ এর ফলে সমাজে সাম্প্রদায়িক ঐক্য ও স্থিতিশীলতা বজায় থাকে।

---

✅ (২) সাহিত্যচর্চার প্রসার

• হুসেন শাহের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলা সাহিত্যের বিকাশ ঘটে। কবি কবিন্দ্রপরমেশ্বর ‘মহাভারত’ বাংলায় অনুবাদ করেন।

• মুকুন্দরাম চক্রবর্তী, বিজয়গুপ্ত, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন প্রভৃতি বৈষ্ণব সাহিত্য রচিত হয় এ সময়ে।

➡️ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উৎকর্ষে হুসেন শাহী রাজবংশ এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

---

✅ (৩) সংস্কৃতি ও শিল্পকলার বিকাশ

• ইসলামি, হিন্দু ও পার্সি শিল্পধারার মিশ্রণে এক অভিনব স্থাপত্যশৈলী গড়ে ওঠে।

• গৌড়, পান্ডুয়া, রাজমহলের মসজিদ, মাদ্রাসা, দরগাহ ইত্যাদি নির্মাণে স্থাপত্যকলা বিকশিত হয়।

➡️ হুসেন শাহী যুগে নির্মিত স্থাপত্য আজও বাংলার গৌরব বহন করে।

---

✅ (৪) শিক্ষা ও জ্ঞানচর্চা

• বিভিন্ন মাদ্রাসা ও পাঠশালা নির্মাণ এবং পণ্ডিত ও আলেমদের পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া হয়।

• আরবি, ফার্সি ও সংস্কৃত ভাষায় অনুবাদ ও পাণ্ডিত্যচর্চা জোরদার হয়।

➡️ ফলে জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রেও বাংলা এক অগ্রণী কেন্দ্র হয়ে ওঠে।

---

✅ (৫) সামরিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা

• হুসেন শাহ বাংলাকে একটি স্বাধীন ও শক্তিশালী রাজ্য হিসেবে গড়ে তোলেন, যা দিল্লি সুলতান বা আফগান শাসকদের প্রভাবমুক্ত ছিল।

• তাঁর শাসনকালে বাংলা সুবর্ণযুগে প্রবেশ করে।

➡️ রাজনৈতিক স্থিতি সাংস্কৃতিক বিকাশের সহায়ক হয়।

---

✅ (৬) বৈদেশিক সম্পর্ক ও বাণিজ্য

• হুসেন শাহের আমলে আরব, পারস্য ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে বাংলার বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

• জলপথে ও স্থলপথে ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসার পায়।

➡️ এর ফলে বাংলায় ধনসম্পদের বৃদ্ধি ঘটে এবং সংস্কৃতির আদান-প্রদান ঘটে।

---

✅ উপসংহার:

হুসেন শাহী বংশ বাংলা ইতিহাসের এক গৌরবময় অধ্যায়। এই রাজবংশের শাসনকালে ধর্মীয় সহিষ্ণুতা, সাহিত্য ও স্থাপত্যের বিকাশ, শিক্ষা প্রসার এবং রাজনৈতিক স্বাধীনতার সমন্বয়ে এক সর্বাঙ্গীন সাংস্কৃতিক উন্মেষ ঘটে। তাই বলা যায়, হুসেন শাহী যুগ ছিল বাংলার সাংস্কৃতিক ইতিহাসে এক স্বর্ণোজ্জ্বল পর্ব।

<<<<<<<<<<<<<<<🌹সমাপ্ত🌹>>>>>>>>>>>