✍️রচনাধর্মী প্রশ্নগুলির উত্তর দাও(প্রশ্নের মান-৫):
📝 ১. ভারতীয় বস্ত্রশিল্প ধ্বংসের কারণগুলি বর্ণনা করো।
✅ উত্তর:
ভারতীয় বস্ত্রশিল্প ধ্বংসের পেছনে ছিল একাধিক কারণ। ইংল্যান্ডে যন্ত্রে তৈরি সস্তা কাপড় করমুক্তভাবে ভারতে আমদানি হতো। এর ফলে স্থানীয় হস্তশিল্প প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ে। ভারতীয় পণ্যের উপর কর চাপানো হলেও ব্রিটিশ পণ্যের উপর শুল্ক বসত না। তাঁতিরা কাঁচামালের অভাবে উৎপাদনে বিঘ্ন ঘটান। তুলা কম দামে ইংল্যান্ডে রপ্তানি করা হতো, ফলে তাঁতিরা ক্ষতিগ্রস্ত হতেন। তাঁতিদের উপর শারীরিক ও মানসিক নিপীড়নও হত। বহু তাঁতি পেশা পরিবর্তন বা নিঃস্ব হতে বাধ্য হন। এরফলে ভারতীয় হস্তশিল্প ধ্বংস হয়ে যায় এবং গ্রামীণ অর্থনীতি দুর্বল হয়।
📝 ২. ঊনবিংশ শতকে ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনের সীমাবদ্ধতা আলোচনা করো।
✅ উত্তর:
ঊনবিংশ শতকে ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনের কিছু ইতিবাচক দিক থাকলেও তা ছিল সীমাবদ্ধ। এ আন্দোলন প্রধানত শহুরে উচ্চশ্রেণির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। গ্রামের সাধারণ মানুষ এই আন্দোলনের আওতার বাইরে থেকে যায়। কিছু সংস্কারক পশ্চিমি শিক্ষায় প্রভাবিত হয়ে ভারতীয় ঐতিহ্যকে অবমূল্যায়ন করেন। জাতপাত, নারী-পুরুষ বৈষম্যের মতো সমস্যার গভীরে পৌঁছাতে পারেননি। বহু ক্ষেত্রেই সমাজের রক্ষণশীল অংশের তীব্র বিরোধিতায় সংস্কার থমকে যায়। হিন্দু ও মুসলিম সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে বিভাজন ছিল। আন্দোলনগুলো ঐক্যবদ্ধ গণআন্দোলনে রূপ নিতে পারেনি। তাই এ আন্দোলনগুলোর প্রভাব সাময়িক এবং সীমিত ছিল।
📝 ৩. কংগ্রেসের চরমপন্থী মতবাদ বা রাজনীতির উদ্ভবের কারণগুলি লেখো।
✅ উত্তর:
চরমপন্থার জন্ম হয় নরমপন্থীদের ব্যর্থতার প্রেক্ষাপটে। ব্রিটিশরা কংগ্রেসের আবেদন ও প্রস্তাবকে গুরুত্ব না দেওয়ায় হতাশা জন্ম নেয়। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের মাধ্যমে চরমপন্থার উত্থান ঘটে। তাঁরা মনে করতেন শক্তি ছাড়া স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব নয়। বাল গঙ্গাধর তিলক, বিপিনচন্দ্র পাল ও লালা লাজপত রায় ছিলেন এর মুখ্য নেতা। চরমপন্থীরা বয়কট, স্বদেশী, শিক্ষা ও স্বরাজের ওপর জোর দেন। তাঁরা জাতীয়তাবাদকে আরও উদ্দীপ্ত করেন। যুবসমাজ এই নীতিকে সমর্থন করে। চরমপন্থা জাতীয়তাবাদের গতিকে ত্বরান্বিত করে।
📝 ৪. ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের সিপাহি বিদ্রোহের কারণ ও ফলাফল আলোচনা করো।
✅ উত্তর:
১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহ ছিল ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ। সিপাহিদের মধ্যে ধর্মীয় ও সামাজিক ক্ষোভ জমে উঠেছিল। গরু-শূকর চর্বিযুক্ত কার্তুস ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা ধর্মীয় অবমাননা ছিল। জমিদার, তালুকদার ও ক্ষুব্ধ কৃষকরাও বিদ্রোহে যোগ দেন। বিদ্রোহটি দিল্লি, কানপুর, ঝাঁসি, লক্ষ্ণৌ-সহ বহু অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। রানি লক্ষ্মীবাই, তাতিয়া টোপে, নানাসাহেব এই বিদ্রোহের গুরুত্বপূর্ণ নেতা ছিলেন। তবে নেতৃত্বহীনতা, সমন্বয়হীনতা ও আধুনিক অস্ত্রের অভাবে বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়। এর ফলস্বরূপ কোম্পানির শাসন শেষ হয়ে ১৮৫৮ সালে ব্রিটিশ রাজ শুরু হয়। রাণির ঘোষণা কিছু প্রতিশ্রুতি দিলেও শাসন আরও কঠোর হয়ে পড়ে।
📝 ৫. ভারতীয় সমাজে ব্রিটিশ রাজস্বনীতির প্রভাব কেমন ছিল?
✅ উত্তর:
ব্রিটিশ রাজস্বনীতি ভারতীয় সমাজে গভীর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল। কৃষকদের উপর করের বোঝা এত বেশি ছিল যে প্রাকৃতিক দুর্যোগেও কর মুকুব হতো না। জমির মালিকানা হারিয়ে বহু কৃষক ভূমিহীন হয়ে পড়েন। কৃষক ও প্রজারা ঋণের ফাঁদে পড়ে মহাজনের দাসত্বে আবদ্ধ হন। রাজস্ব আদায়কারী জমিদার ও মহাজনেরা দমননীতি গ্রহণ করে। গ্রামীণ অর্থনীতি ধ্বংস হতে থাকে। কৃষিভিত্তিক সমাজে দারিদ্র্য ও ক্ষোভ জন্মে। এর ফলে বহু কৃষক বিদ্রোহ ও গণঅসন্তোষের জন্ম হয়। রাজস্বনীতিই পরবর্তী জাতীয়তাবাদের পেছনে অন্যতম কারণ হয়ে ওঠে।
📝 ৬. সমাজ ও শিক্ষাসংস্কারে বিদ্যাসাগরের ভূমিকা কী ছিল?
✅ উত্তর:
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ছিলেন বাংলা নবজাগরণের অন্যতম পথপ্রদর্শক। নারীশিক্ষার বিস্তারে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। তিনি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন এবং সমাজকে নারীশিক্ষায় উদ্বুদ্ধ করেন। ১৮৫৬ সালে বিধবাবিবাহ আইন পাশ করাতে তিনি অগ্রণী ভূমিকা নেন। তিনি বাল্যবিবাহ ও বহু বিবাহের বিরুদ্ধে যুক্তিনির্ভর আন্দোলন করেন। সহজ-সরল বাংলা গদ্যরীতি প্রবর্তনে তিনি মৌলিক ভূমিকা রাখেন। বাংলার বহু স্কুলে তিনি শিক্ষক নিয়োগ ও শিক্ষার মানোন্নয়নের উদ্যোগ নেন। দরিদ্র, সাধারণ মানুষের শিক্ষা বিস্তারে তাঁর অবদান অসাধারণ। তিনি মানবতাবাদ, যুক্তিবাদ এবং সমাজকল্যাণে নিজেকে সমর্পণ করেছিলেন।
📝 ৭. কংগ্রেসের সাংগঠনিক দুর্বলতাগুলি আলোচনা করো।
✅ উত্তর:
কংগ্রেসের আদিপর্বে বেশ কিছু সাংগঠনিক দুর্বলতা ছিল। এটি ছিল মূলত উচ্চবর্ণের শিক্ষিতদের সংগঠন। সাধারণ কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষের অংশগ্রহণ ছিল না। কংগ্রেসের সদস্য সংখ্যা খুবই সীমিত ছিল। আর্থিক সংগঠন দুর্বল থাকায় আন্দোলন ধারাবাহিকতা হারাত। সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিভাজন ছিল, বিশেষত নরম ও চরমপন্থীদের মধ্যে। দাবি-দাওয়াগুলি ছিল আবেদনমুখী, প্রতিবাদী নয়। জনসাধারণের ভাষায় কর্মসূচি উপস্থাপিত হত না। ফলে জনজাগরণে কংগ্রেস প্রথমে সফল হতে পারেনি।
📝 ৮. মুসলিম সমাজসংস্কারে স্যার সৈয়দ আহমদ-এর ভূমিকা আলোচনা করো।
✅ উত্তর:
স্যার সৈয়দ আহমদ মুসলিম সমাজের শিক্ষার প্রসারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। ১৮৫৭-এর পর মুসলিমরা ব্রিটিশ শিক্ষাব্যবস্থা থেকে পিছিয়ে পড়ে। তিনি মুসলিমদের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে চেয়েছিলেন। ১৮৭৫ সালে আলিগড়ে মোহামেডান অ্যাংলো ওরিয়েন্টাল কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। পরে সেটিই আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়। তিনি বিজ্ঞান, যুক্তিবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষার প্রচার করেন। ‘Tahzib-ul-Akhlaq’ পত্রিকার মাধ্যমে সমাজ সংস্কারমূলক চিন্তা ছড়ান। তিনি হিন্দু-মুসলিম ঐক্যে অবিশ্বাসী হলেও মুসলিম সমাজে নবজাগরণ আনেন। স্যার সৈয়দ মুসলিম আধুনিক শিক্ষার জনক হিসেবে স্মরণীয়।
📝 ৯. রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত ও মহলওয়ারি বন্দোবস্ত সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।
✅ উত্তর:
রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত চালু করেন টমাস মানরো দক্ষিণ ভারতে। এতে জমির মালিক হিসেবে কৃষক নিজেই স্বীকৃত হতেন এবং সরাসরি সরকারের কাছে খাজনা দিতেন। এতে মধ্যস্বত্বভোগী না থাকায় কৃষকদের কিছু সুবিধা ছিল, তবে খাজনার হার ছিল অত্যন্ত বেশি। খরা, অনাবৃষ্টির সময়েও কর মুকুব হতো না। অপরদিকে, মহলওয়ারি বন্দোবস্ত প্রবর্তন করেন হোল্ট ম্যাকেঞ্জি ও রবার্ট মার্টিন। এটি ছিল উত্তর-পশ্চিম ভারতে প্রচলিত এক বন্দোবস্ত, যেখানে গোটা গ্রাম বা 'মহল' একত্রে কর দিত। গ্রামের জমিদার বা মোখাদম প্রায়ই এই কর সংগ্রহ করতেন। এই ব্যবস্থায়ও কৃষকদের উপর করের চাপ ছিল বেশি, এবং জমির প্রকৃত মালিকানা স্পষ্ট ছিল না। দুটি ব্যবস্থাতেই কৃষকের দুর্দশা ঘোচে না, বরং ঋণ ও দারিদ্র্য বেড়ে যায়।
📝 ১০. ঔপনিবেশিক শাসনে ভারতের দারিদ্র্যের কারণগুলি লেখো।
✅ উত্তর:
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনে ভারতের দারিদ্র্য দিন দিন বেড়ে যায়। প্রথমত, কৃষিভিত্তিক অর্থনীতিতে ভারসাম্যহীন রাজস্বনীতি কৃষকদের নিঃস্ব করে। দ্বিতীয়ত, হস্তশিল্প ধ্বংস ও বিদেশি পণ্যের দাপটে গ্রামীণ কারিগররা কাজ হারায়। তৃতীয়ত, বৃটিশ পুঁজিপতিরা কাঁচামাল সস্তায় নিয়ে গিয়ে শিল্পপণ্য রপ্তানি করতেন, ফলে ভারতে মুনাফার ভাগ থাকত না। রেলপথ, সড়ক, প্রশাসন—সব কিছুতেই ভারতীয় অর্থ ব্যয় হলেও মুনাফা যেত ইংল্যান্ডে। শিক্ষার সুযোগ ছিল সীমিত, ফলে কর্মসংস্থান কম ছিল। তদুপরি, ঔপনিবেশিক নীতির ফলে ভারতের সম্পদ বাইরে চলে যেত—যাকে বলে “সম্পদের বহির্গমন”। এসব কারণে ভারতীয় অর্থনীতি দুর্বল হয়ে পড়ে এবং ব্যাপক জনগোষ্ঠী চরম দারিদ্র্যের শিকার হয়।
📝 ১১. বাংলায় সমাজসংস্কার আন্দোলনে রাজা রামমোহন রায়ের ভূমিকা আলোচনা করো।
✅ উত্তর:
রাজা রামমোহন রায় ছিলেন বাংলার সমাজসংস্কার আন্দোলনের অগ্রদূত। তিনি যুক্তিবাদ, মানবতাবাদ ও ধর্মীয় সহনশীলতার ভিত্তিতে সমাজ সংস্কারে ব্রতী হন। সতীপ্রথা, বহুবিবাহ, বাল্যবিবাহের মতো কুসংস্কার ও অনৈতিক প্রথার বিরুদ্ধে তিনি তীব্র প্রতিবাদ গড়ে তোলেন। ১৮২৮ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘ব্রাহ্ম সমাজ’, যার মাধ্যমে ধর্মীয় ও সামাজিক পুনর্জাগরণ সূচিত হয়। তিনি নারীদের শিক্ষার পক্ষে এবং নারীর অধিকার রক্ষায় ছিলেন অগ্রগামী। সতীপ্রথা রোধে তাঁর নিরলস প্রচেষ্টার ফলস্বরূপ ১৮২৯ সালে লর্ড বেথিঙ্ক সতী নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। তিনি ইংরেজি শিক্ষার প্রসার ও বিজ্ঞানচর্চার পক্ষে ছিলেন। তাঁর রচনার মধ্যে ‘সমবাদ কৌমুদী’ ও ‘দ্য প্রিসেপ্টস অফ জেসাস’ উল্লেখযোগ্য। তাঁকে ‘ভারতের নবজাগরণের জনক’ বলা হয়।
📝 ১২. স্বাধীনতা সংগ্রামে চরমপন্থী মতবাদের উত্থানের কারণগুলি আলোচনা করো।
✅ উত্তর:
চরমপন্থী মতবাদের উত্থান ছিল মূলত নরমপন্থার ব্যর্থতার প্রতিক্রিয়া। নরমপন্থীরা ব্রিটিশ শাসকের প্রতি আস্থা রেখে আবেদন, প্রার্থনা ও দরবারের মাধ্যমে অধিকার আদায়ের চেষ্টা করেন। কিন্তু তাঁদের এই নীতির ফলে কোনো বাস্তব ফল আসেনি। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় ব্রিটিশ সরকারের দমননীতির কারণে তরুণ সমাজ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। এতে চরমপন্থী নেতা ও যুবসমাজ বিশ্বাস করতে শুরু করে যে, স্বাধীনতা অর্জনের জন্য শক্তি ও আত্মত্যাগের প্রয়োজন। বাল গঙ্গাধর তিলক, লালা লাজপত রায়, বিপিনচন্দ্র পাল ছিলেন এই ধারার নেতৃস্থানীয় মুখ। তাঁরা স্বরাজ, স্বদেশী, বয়কট ও জাতীয় শিক্ষার মত কার্যকরী কর্মসূচি গ্রহণ করেন। দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগের মাধ্যমে তাঁরা নতুন ধারার সূচনা করেন। এই ধারাই পরবর্তীকালে বিপ্লবী আন্দোলন ও গণআন্দোলনের ভিত্তি রচনা করে।
<<<<<<<<<<<<<<<<🌹সমাপ্ত🌹>>>>>>>>>>>