✍️ভাবসম্প্রসারণ(প্রশ্নের মান-৫):
১. ‘ধর্মের বেশে মোহ যারে এসে ধরে, অন্ধ সে জন মারে আর শুধু মরে।’
উঃ যখন ধর্ম মানুষকে মোহগ্রস্ত করে, তখন তার সত্য জ্ঞানের পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। সে হয়ে ওঠে ধর্মান্ধ এবং অন্ধবিশ্বাসের দ্বারা চালিত হয়। এমন পরিস্থিতিতে সে সহিংসতায় লিপ্ত হয়, অন্যকে আঘাত করে এবং নিজেও ক্ষতির সম্মুখীন হয়।
ধর্মের মূল উদ্দেশ্য হলো মানুষের আধ্যাত্মিক উন্নতি ও সুস্থ সমাজ গঠন করা। তবে, বর্তমানে সাম্প্রদায়িকতা সেই উদ্দেশ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। ‘আমার ধর্ম বনাম তোমার ধর্ম’ এই বিভাজন মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করছে। কিছু স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী এই বিভেদের সুযোগ নিয়ে সমাজকে দুর্বল করছে। ধর্মের প্রকৃত অর্থ না বুঝে অনেকেই ধর্মান্ধতায় লিপ্ত হচ্ছে। প্রকৃত ধর্মের শিক্ষা শান্তি ও মানবকল্যাণ হলেও, তারা কেবল সাম্প্রদায়িকতাকেই ধর্মকর্ম মনে করছে। তাই, ধর্মান্ধতার কারণে নিজেরা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তেমনি সমাজেরও সর্বনাশ ঘটাচ্ছে।
২. ‘মেঘ দেখে কেউ করিসনে ভয় আড়ালে তার সূর্য হাসে।’
উঃ মানুষের জীবনে সুখ ও দুঃখ একে অপরের পরিপূরক। কোনো মানুষের জীবনেই কেবলমাত্র সুখ বা কেবলমাত্র দুঃখ চিরস্থায়ী হয় না। সুখ ও দুঃখ পালাক্রমে আসে এবং যায়। যখন দুঃখ আসে, তখন তা খুবই কষ্টকর মনে হয়। সেই সময় মনে হয়, দুঃখের সেই অন্ধকারের আর কোনো শেষ নেই। কিন্তু বাস্তবে দুঃখ কখনো স্থায়ী হয় না। অন্ধকার রাতের শেষে যেমন আলোর সূচনা হয়, তেমনি দুঃখের পর আসে সুখের সময়। দুঃখের মুহূর্তে ভেঙে পড়লে চলবে না। ধৈর্য সহকারে দুঃখের মোকাবিলা করতে হবে। প্রতিকূল পরিস্থিতি সামলানোর জন্য সাহস ও দৃঢ় মনোভাব দরকার। সংগ্রামের মাধ্যমে মানুষ দুঃখের অন্ধকারকে কাটিয়ে উঠতে পারে। জীবনের পথ কখনোই মসৃণ নয়। সমস্যার মধ্যেও লুকিয়ে থাকে সফলতার চাবিকাঠি। সুখ ও দুঃখের এই পালাবদলই জীবনের স্বাভাবিক নিয়ম। মানুষের জীবনচক্র এই পরিবর্তনের মধ্য দিয়েই পূর্ণতা লাভ করে। অতএব, জীবনে দুঃখ এলে ভয় না পেয়ে দৃঢ়চিত্তে তা মোকাবিলা করাই শ্রেয়।
৩. ‘সবার ওপরে মানুষ সত্য, তাহার ওপরে নাই।’
উঃ ঈশ্বর মানুষকে সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। তাই মানুষের মূল্য ও সম্মান ঠিকভাবে বোঝা দরকার। মানুষের মধ্যে ধর্ম, জাতি বা ধনী-দরিদ্রের ভেদাভেদ করা উচিত নয়।
আজকের সমাজে মানুষে মানুষে অনেক বিভেদ দেখা যায়। কেউ উঁচু, কেউ নিচু বলে মানুষকে আলাদা করা হয়। ধনী-দরিদ্র, শক্তিশালী-দুর্বল এসব বিভেদ মানুষের শান্তি নষ্ট করছে। শক্তিশালী জাতি দুর্বল জাতিকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করে। ফলে মানুষে মানুষে দ্বন্দ্ব বেড়েই চলেছে।
এই পরিস্থিতি বদলানোর জন্য আমাদের সবাইকে এক হয়ে কাজ করতে হবে। মানুষের প্রকৃত মূল্য বুঝতে হবে। কেউ কারো থেকে বড় বা ছোট নয়। সবাই সমান মর্যাদা পাওয়ার যোগ্য।
সব মানুষের কল্যাণের জন্য চেষ্টা করতে হবে। একে অপরকে সম্মান ও ভালোবাসা দেখাতে হবে। তবেই পৃথিবী সত্যিকারের সুন্দর ও শান্তিময় হয়ে উঠবে। মানবতার উন্নতির জন্য সবার আগে মানুষকে মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করা দরকার।
৪. “যারে তুমি নীচে ফেল সে তোমারে বাঁধিবে যে নীচে, পশ্চাতে রেখেছ যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে।”
উঃ সমাজে ধনী, শিক্ষিত, এবং ক্ষমতাবানদের পাশাপাশি দরিদ্র, মূর্খ, অসহায় এবং নিম্নবর্ণের মানুষও বসবাস করে। সবাইকে নিয়েই সমাজ গঠিত এবং সবার উন্নতিতে সমাজের উন্নতি নির্ভর করে। সমাজের উন্নতি ঘটলে দেশের অগ্রগতিও নিশ্চিত হয়। যদি দরিদ্র ও অবহেলিত মানুষদের ঘৃণার চোখে দেখা হয়, তাহলে সমাজের প্রকৃত উন্নতি সম্ভব নয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ এই অবহেলিত শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় তাদের উন্নয়ন ছাড়া সমাজের অগ্রগতি অসম্ভব। এরা অবহেলিত অবস্থায় থাকলে অশিক্ষা, দারিদ্র্য ও কুসংস্কার সমাজের ক্ষতি বাড়ায়। তাদের পাশে দাঁড়ানো ও সঠিক শিক্ষার আলোয় আলোকিত করা প্রয়োজন। তাদের অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে হবে। একমাত্র তখনই সমাজের সঠিক উন্নয়ন সম্ভব হবে। সমাজের মুষ্টিমেয় ধনী ও শিক্ষিত মানুষের অহংকার সমাজের অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।
৫. “এ জগতে হায়, সেই বেশি চায় আছে যার ভুরিভুরি, রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি।”
উঃ ধনী মানুষেরা সবসময় আরও বেশি সম্পদ পাওয়ার লোভে থাকে। তারা নিজেদের সম্পদ বাড়ানোর জন্য গরিব ও অসহায় মানুষের সম্পদ কেড়ে নিতেও দ্বিধা করে না। ধনীদের এই লোভের কারণে গরিব মানুষেরা দিন দিন আরও দরিদ্র হয়ে পড়ে। ধনী লোকেরা যতই পায়, ততই তাদের চাওয়া বাড়ে। তারা গরিবদের কষ্ট এবং দুর্দশার কথা ভাবতে চায় না। এই বৈষম্যের কারণে সমাজে অশান্তি এবং সংঘাত দেখা দেয়। দরিদ্র মানুষেরা তাদের ন্যায্য অধিকার পায় না এবং সর্বস্বান্ত হয়ে পথে বসে। ধনীরা তাদের ঐশ্বর্য বাড়ানোর লোভে গরিবদের শেষ সম্বলও কেড়ে নিতে দ্বিধা করে না। অথচ সমাজের উন্নতির জন্য দরিদ্রদেরও বাঁচার অধিকার থাকা উচিত। ধনীদের উচিত তাদের লোভ কমিয়ে দরিদ্রদের সহায়তা করা। তাহলেই সমাজে শান্তি ও সমতা ফিরে আসবে।
৬. “স্বার্থমগ্ন যে জন বিমুখ / বৃহৎ জগৎ হতে / সে কখনো শেখেনি বাঁচিতে।”
উঃ স্বার্থপর মানুষ আসলে জীবিত থেকেও মৃতের মতো। যে ব্যক্তি কেবল নিজের স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত থাকে, তার জীবনের কোনো মূল্য থাকে না। কারণ, স্বার্থের পেছনে ছুটতে ছুটতে তার আত্মা মরে যায়।
মানুষ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি, কারণ তার বুদ্ধি, মনুষ্যত্ব ও সহযোগিতার মনোভাব তাকে অন্যদের থেকে আলাদা করে। একজন মানুষ একা কখনোই সবকিছু করতে পারে না। তাই সমাজে সবাইকে মিলেমিশে একে অপরকে সাহায্য করে চলতে হয়। কিন্তু যারা কেবল নিজেদের স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত থাকে, তারা কখনো প্রকৃত অর্থে বাঁচতে শেখে না। ভালোবাসা, সহানুভূতি, দয়া আর সহযোগিতা ছাড়া জীবন একেবারেই অর্থহীন। স্বার্থপরতা, লোভ আর হিংসা মানুষের মনুষ্যত্বকে ধ্বংস করে দেয়। যে ব্যক্তি শুধু নিজের লাভের কথা ভাবে, সে মানুষের কল্যাণের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তার জীবন যেন অর্থহীন হয়ে পড়ে। তাই প্রকৃত মানুষ হতে চাইলে আমাদের স্বার্থপরতা ছেড়ে সহযোগিতা ও কল্যাণের পথেই চলতে হবে। এই পথেই জীবনের সত্যিকারের অর্থ খুঁজে পাওয়া যায়।
৭. “নদীর এপার কহে ছাড়িয়া নিশ্বাস, ওপারেতে সর্বসুখ আমার বিশ্বাস। নদীর ওপার বসি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে কহে, যাহা কিছু সুখ সকলি ওপারে।”
উঃ এই পৃথিবীতে কেউই নিজের বর্তমান অবস্থায় পুরোপুরি সুখী নয়। সবাই মনে করে, অন্যরা অনেক বেশি সুখী, আর এভাবেই নিজের দুঃখকে বাড়িয়ে তোলে।
পৃথিবীর সব মানুষই কোনো না কোনোভাবে সুখের সন্ধানে ব্যস্ত থাকে। সবাই মনে করে, অন্যরা ভালো আছে আর সে নিজেই সবচেয়ে দুঃখী। একজন গরিব মানুষ ভাবে, ধনী হওয়া মানেই সুখ, আর ধনী মানুষ ভাবে, সাধারণ মানুষের মতো চিন্তামুক্ত জীবনেই আসল শান্তি। নদীর এপার থেকে ওপারকে সুখী মনে হয়, আবার ওপার থেকে এপারকে। আসলে মানুষের চাওয়ার শেষ নেই। যা নেই তা পাওয়ার জন্য মানুষ সবসময় ব্যস্ত থাকে। তার আকাঙ্ক্ষা অনেক, কিন্তু তা পূরণ করার ক্ষমতা খুব কম। তাই সে যতই কিছু অর্জন করুক না কেন, মনে হয় আরো চাই। এমনকি যা কিছু সে পায়, সেগুলো তার মনকে পরিপূর্ণ তৃপ্তি দিতে পারে না। এই অতৃপ্ত চাওয়াই তাকে সারাজীবন কষ্ট দেয়। মানুষ সবসময় এমন কিছু খুঁজে বেড়ায় যা কখনোই পুরোপুরি পাওয়া সম্ভব নয়। এভাবেই সে অজানা সুখের সন্ধানে ছুটতে থাকে, কিন্তু কখনোই আসল সুখের নাগাল পায় না।
৮. “অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে তব ঘৃণা তারে যেন তৃণসম দহে।”
উঃ অন্যায়কারী এবং অন্যায় সহ্যকারী উভয়েই সমানভাবে দোষী। যারা সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে তারা যেমন অপরাধী, তেমনি যারা চুপচাপ অন্যায় সহ্য করে তারাও অপরাধী।
মানুষ সমাজে বাস করে বলে তাকে সামাজিক নিয়ম-কানুন মেনে চলতে হয়। সৃষ্টিকর্তা মানুষের জন্য কিছু নিয়ম বেঁধে দিয়েছেন, যেগুলো ধর্মীয় বিধি-নিষেধ হিসেবে পরিচিত। আবার, সমাজের কল্যাণ ও শান্তি রক্ষার জন্য মানুষ নিজেও কিছু নিয়ম তৈরি করেছে। কিন্তু সবসময় সবাই এই নিয়ম মেনে চলে না। কিছু মানুষ সমাজের নিয়ম ভেঙে অন্যকে কষ্ট দেয়, অন্যের অধিকার কেড়ে নেয় এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। যারা এ ধরনের অন্যায় দেখে চুপ থাকে, তারাও প্রকৃতপক্ষে অপরাধে সহায়তা করে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা না বললে বা প্রতিবাদ না করলে সেই অন্যায় আরও বেড়ে যায়। অপরাধীও সাহসী হয়ে ওঠে এবং তার ক্ষমতা বাড়াতে থাকে। তাই অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো উচিত, নয়তো সমাজের শান্তি ও শৃঙ্খলা নষ্ট হয়ে যাবে। ক্ষমা অবশ্যই ভালো গুণ, তবে অপরাধীকে সবসময় ক্ষমা করতে থাকলে সে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। অন্যায়কে রুখতে হলে সবাইকে সচেতন হতে হবে এবং অপরাধীদের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নিতে হবে।
<<<<<<<<<<<<<<<🌹 সমাপ্ত 🌹>>>>>>>>>>>